রাস্তার ওপার থেকেই হাঁক তুষার বন্দ্যোপাধ্যায়, আমার বাংলার মাস্টারমশাই তুষারবাবুর। রীতিমতো উচ্চস্বরে, ‘অ্যাই কাশীনাথ, এ দিকে আয়।’ মাস্টারমশাই ডাকলে অগ্রাহ্য করার ব্যাপারই ছিল না। মফঃস্বলের ছাত্র, দেখলে তো বটেই, গলা শুনলেও সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়াত। আমিও তৎক্ষণাৎ নেমে সাইকেল হাঁটিয়ে স্যরের দিকে।
তুষারবাবুর পরিচয় আলাদা করে বলার কিছু নেই এখানে। বাংলা পড়াতেন। মন্দ্র বলতে যা বোঝায়, স্বর তেমন। পড়ানোর সময় যেভাবে বলতেন, পুচ্ছপাকা ছেলেরাও তন্ময় হয়ে শুনত। আমাদের বীরপাড়া হাই স্কুলে প্রতি বছর স্পোর্টস হয়, ৪ ফেব্রুয়ারি, স্কুলের প্রতিষ্ঠাদিবসে। রেডিওয় তখনকার ধারাভাষ্যকারদের নিয়মিতই শুনেছি, খেলাপ্রীতির কারণে। কিন্তু, তুষারবাবুর গলায় স্পোর্টসের ধারাবিবরণীর তুলনায় সবই ম্লান। এবং, যদি মনে হয় পক্ষপাতদুষ্ট, আমি অনন্যোপায়!
উত্তরবঙ্গের অন্যতম সেরা কবি ছিলেন প্রয়াত তুষার বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর ‘অললই ঝললই মাদারের ফুল’ কাব্যগ্রন্থ এবং কবিতাগুলি এখনও উত্তরবঙ্গের মানুষের স্মৃতিতে ঝলমলে। আমাদের স্কুলবেলায় সম্পাদনা করতেন ‘বনভূমি’ কবিতা-পত্রিকা। বাবার সঙ্গে বেশ বন্ধুতা। মাঝেমাঝেই বাড়ি আসতেন ‘বনভূমি’-র জন্য অনুদানের সন্ধানে। আর আমাকে বকতেন, কবিতা পড়ি না বলে।
অদ্ভুত সুন্দর হাতের লেখা। রাবীন্দ্রিক নয়, তিনি যে ‘হাংরি জেনারেশন’ ভক্ত। তাঁর হাতের লেখাও তাই অন্য ঘরানার। একবার ক্লাসে এসে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে শুরুই করেছিলেন, ‘এক সুন্দর রৌদ্রকরোজ্জ্বল প্রভাতে নরসুন্দরের নিকট যাইয়া মস্তক মুণ্ডন করাইয়া ফেলিলাম!’ কেন স্যর, সমস্বরে প্রশ্ন। তখন কলেজে, অন্যরকম ভাবনা মাথায়। তাই ব্রাহ্মণসন্তান হয়েও অন্যরকম প্রতিবাদের ভাষা খুঁজেছিলেন ন্যাড়া হয়ে, জানিয়েছিলেন। হাতের লেখাতেও অন্যরকম হয়ত সচেতনেই। জেনে নেওয়া হয়নি, কারণ, প্রশ্নগুলো যখন জেগেছিল মনে, তিনি তখন অনেক দূর।
বাংলা পড়তে এবং লিখতে শেখা তাঁদের হাত ধরেই। মজার একটা ঘটনা এই ফাঁকে বলেই ফেলি।
আমাদের মাধ্যমিকের বাংলা ‘ওরাল’। ১৯৮৫ সাল, স্কুলের কোনও একটা ঘরে। প্রায় সবার শেষে ডাক পড়ল। তুষারবাবু সামনেই বসে। একাই ছিলেন বোধহয়। পরবর্তী কথোপকথন –
স্যর: এই যে বাবা কাশীনাথ, এসো বোসো। বল্ তো, তোর নাম দিয়ে কোন দেবতাকে বোঝানো হয়?
ছাত্র: (কোনও রকমে বসেছি, তার আগেই প্রশ্ন) শিব, স্যর।
স্যর: তা, সেই শিবের আরও গোটা পাঁচেক নাম বল্।
ছাত্র: মহাদেব, শঙ্কর, ভোলানাথ, নীলকণ্ঠ, মহেশ (বোধহয় এগুলোই বলেছিলাম, এত দিন পর আর মনে নেই, কিন্তু এই পাঁচটা নাম টাইপ করতে করতে মনে পড়ল, তাই লিখলাম!)
ছাত্র: হ্যাঁ স্যর, গানভঙ্গ।
স্যর: বল্ তো দেখি?
ছাত্র: (দুরুদুরু বক্ষে, মাত্র দুটোই লাইন জানি যে!) গাহিছে কাশীনাথ নবীন যুবা ধ্বনিতে সভাগৃহ ঢাকি/ কণ্ঠে খেলিতেছে সাতটি সুর সাতটি যেন পোষাপাখি…
স্যর: ঠিক আছে, এবার তোর নামের সমাস বল।
ছাত্র: কাশীর নাথ, ষষ্ঠী তৎপুরুষ, স্যর।
স্যর: তোর নামটার সন্ধি হয় না, তাই না?
ছাত্র: (কাঁচুমাচু) হলেও আমি জানি না স্যর…
তারপর নাম ছেড়ে পড়ার অংশে। বাকিগুলো আর মনে নেই। মিনিট দশ পর শেষে শুধু বলেছিলেন, ‘রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা’ গল্পের শেষে একটা উইল ছিল। মনে আছে, বলতে পারবি?’ আগের সব প্রশ্নগুলো মোটামুটি বলতে পারায় ছদ্ম-আত্মবিশ্বাসী হয়ে বলেই ফেললাম, পারব।
‘যদি পারিস, কথা দিচ্ছি, হায়েস্ট দেব তোকেই।’
সামান্য ছলের সাহায্য নিয়েছিলাম এখানে। গল্পটা সাধুভাষায় লেখা। আর, উইলের বিষয়বস্তুও জানাই ছিল। সাহস করে সাধুভাষায় সেটাই বলে দিয়েছিলাম। মৃদু হাসি, ধরতে পেরেছিলেন ঠিক। কিছু বলেননি আর। বেরিয়ে এসেছিলাম। মাধ্যমিকের ফল বেরনোর পর জানতে পারি, ২০-তে ১৭ দিয়েছিলেন। সর্বোচ্চ কিনা, খোঁজ নেওয়া হয়নি। আমাদের সময় তো আর ১৯ বা ২০ দেওয়া হত না। ১৭-ই অনেক ভেবে বেশ পুলকিত, এখনও, এই বছর তেত্রিশ পরও!
তা, সেই স্যর যখন রাস্তার মাঝেই ডেকে পাঠান, তা-ও আবার স্বাভাবিকের চেয়ে উঁচু গলায়, আমার মতো ভীতু ছাত্রের বুক ধড়ফড়। নিশ্চয়ই কোথাও কিছু ভুল করেছি। আমাদের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা তখন সামনেই। হয়ত দিন পনের বা সপ্তাহ তিনেক বাকি। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস স্যরের খুবই প্রিয় বিষয়। ওই বিষয়েই একটি ‘টেক্সটবুক’ও লিখেছিলেন। বইটা না পড়লে সত্যিই হয়ত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে উৎসাহ জাগত না। ভাবছিলাম, সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে কিছু বকাবকি শুনতে হবে এবার।
কোথায় কী! কাছে যেতেই নির্দেশ, ‘বাবার কাছ থেকে আমাদের মিষ্টি খাওয়ানোর টাকা নিয়ে বেরিয়েছিস তো? যা, কিনে নিয়ে আয়। বড় রসগোল্লা আনবি।’
আমার মুখ বড় রসগোল্লা ঢোকানোর মতোই হাঁ। মিষ্টি কেনার টাকা নিয়ে বেরতে যাব কেন? পরীক্ষার ফল বেরলে এবং তা আদৌ মিষ্টি খাওয়ানোর মতো হলে তা-ও নয় বুঝতাম। তখনও তো পরীক্ষাই হয়নি। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি স্যরের দিকে।
‘অবাক হচ্ছিস কেন? এত বড় একটা ব্যাপার, স্যরকে মিষ্টিও খাওয়াবি না? তোকে বাংলা লিখতে শেখাল কে? আমি তো তাঁদেরই একজন।’
আমি কিছুই বুঝিনি তখনও। ডেকে নিয়ে পাশে বসালেন। রহস্য ভাঙল তারপর। কবির সেই শান্তিনিকেতনী ঝোলা থেকে বেরল ‘দেশ’ পত্রিকা। পাতাটা বের করে চোখের সামনে তুলে জিজ্ঞাসা, ‘এই যে কাশীনাথ ভট্টাচার্য, বীরপাড়া, জলপাইগুড়ি লেখা আছে, সেটা তুই নয়? বীরপাড়ায় কাশীনাথ ভট্টাচার্য আর কে আছে রে? আমাকে মেনে নিতে হবে তুই এটা দেখিসনি?’
বিস্ময়ের শেষ নেই আমার তখন। কবে সেই একটা চিঠি লিখে পাঠিয়েছিলাম ‘দেশ’ পত্রিকায়, হোপ এইট্টিসিক্স নিয়ে। সেই চিঠিটা ছাপা হয়েছে, চোখের সামনে নিজের নাম ‘দেশ’ পত্রিকায়। এবং আমি তখনও হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দিইনি!
বাড়িতে ‘দেশ’ আসত নিয়ম করেই। হয়ত সেই দিনই এসেছিল বা আগের দিন। বীরপাড়ায় এই বইগুলো তখনও হাতেগোনা। সব বাড়িতে মোটামুটি একই দিনে দিয়ে দেওয়া হত, সেই দশবারো কপি। আসন্ন পরীক্ষার কারণেই হয়ত দেখে ওঠা হয়নি। এমনকি মা-ও দেখেনি তখনও। দেখলে তো বলতই। আমিও জানতে পারতাম।
স্যর প্রথমে রাগ করেছিলেন একটু। পরে বুঝলেন, সত্যিই দেখিনি। কারণ, স্যরের হাত থেকে বইটা নিয়ে আমি ততক্ষণে পড়তে শুরু করে দিয়েছি। এ আনন্দ রাখি কোথায়, এমন একটা ভাব। রীতিমতো উড়ছি!
মিষ্টিটা পরে স্যর বাড়ি এসেই খেয়ে গিয়েছিলেন। পরীক্ষার জন্য উৎসাহ মাস্টারমশাই দেবেন, স্বাভাবিক। কিন্তু তুষারবাবু বরাবর ভালবাসতেন অন্য কিছু চেষ্টা করলে। নেহাতই একটি চিঠি তো কী? তখন, সেই ১৯৮৭ সালে, ‘দেশ’ পত্রিকা সত্যিই বাংলা সাহিত্যসংস্কৃতির ধারকবাহক। সেই পত্রিকায় ছাত্রের চিঠি প্রকাশিত হয়েছে, মাস্টারমশাইয়ের আনন্দ যেন ছাত্রের চেয়েও বেশি।
অস্বীকার করছি না, নিজেরও বেশ ভালই লেগেছিল। ছাপার অক্ষরে নাম সেই প্রথম। আমি তখনও অনূর্ধ্ব-১৭। ‘খেলা’ পত্রিকায় তারপর অনেক চিঠি লিখেছিলাম। কিন্তু, শুরুটা ‘দেশ’-এ। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে, বেশ বড়সড় প্রাপ্তি আমার।
** অললই এবং তুষারবাবুর হাতের লেখার ছবি পার্থ পাঠিয়েছিল, স্যরের ছেলে বুম্বার (অনন্য) থেকে নিয়ে। পার্থকেও অজস্র ধন্যবাদ