Monday, February 24, 2020

‘দেশ’ পত্রিকায় প্রথম চিঠি ও তুষারবাবু / কাশীনাথ ভট্টাচার্য


রাস্তার ওপার থেকেই হাঁক তুষার বন্দ্যোপাধ্যায়, আমার বাংলার মাস্টারমশাই তুষারবাবুর। রীতিমতো উচ্চস্বরে, ‘অ্যাই কাশীনাথ, এ দিকে আয়।’ মাস্টারমশাই ডাকলে অগ্রাহ্য করার ব্যাপারই ছিল না। মফঃস্বলের ছাত্র, দেখলে তো বটেই, গলা শুনলেও সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়াত। আমিও তৎক্ষণাৎ নেমে সাইকেল হাঁটিয়ে স্যরের দিকে।
তুষারবাবুর পরিচয় আলাদা করে বলার কিছু নেই এখানে। বাংলা পড়াতেন। মন্দ্র বলতে যা বোঝায়, স্বর তেমন। পড়ানোর সময় যেভাবে বলতেন, পুচ্ছপাকা ছেলেরাও তন্ময় হয়ে শুনত। আমাদের বীরপাড়া হাই স্কুলে প্রতি বছর স্পোর্টস হয়, ৪ ফেব্রুয়ারি, স্কুলের প্রতিষ্ঠাদিবসে। রেডিওয় তখনকার ধারাভাষ্যকারদের নিয়মিতই শুনেছি, খেলাপ্রীতির কারণে। কিন্তু, তুষারবাবুর গলায় স্পোর্টসের ধারাবিবরণীর তুলনায় সবই ম্লান। এবং, যদি মনে হয় পক্ষপাতদুষ্ট, আমি অনন্যোপায়!
উত্তরবঙ্গের অন্যতম সেরা কবি ছিলেন প্রয়াত তুষার বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর ‘অললই ঝললই মাদারের ফুল’ কাব্যগ্রন্থ এবং কবিতাগুলি এখনও উত্তরবঙ্গের মানুষের স্মৃতিতে ঝলমলে। আমাদের স্কুলবেলায় সম্পাদনা করতেন ‘বনভূমি’ কবিতা-পত্রিকা। বাবার সঙ্গে বেশ বন্ধুতা। মাঝেমাঝেই বাড়ি আসতেন ‘বনভূমি’-র জন্য অনুদানের সন্ধানে। আর আমাকে বকতেন, কবিতা পড়ি না বলে।
অদ্ভুত সুন্দর হাতের লেখা। রাবীন্দ্রিক নয়, তিনি যে ‘হাংরি জেনারেশন’ ভক্ত। তাঁর হাতের লেখাও তাই অন্য ঘরানার। একবার ক্লাসে এসে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে শুরুই করেছিলেন, ‘এক সুন্দর রৌদ্রকরোজ্জ্বল প্রভাতে নরসুন্দরের নিকট যাইয়া মস্তক মুণ্ডন করাইয়া ফেলিলাম!’ কেন স্যর, সমস্বরে প্রশ্ন। তখন কলেজে, অন্যরকম ভাবনা মাথায়। তাই ব্রাহ্মণসন্তান হয়েও অন্যরকম প্রতিবাদের ভাষা খুঁজেছিলেন ন্যাড়া হয়ে, জানিয়েছিলেন। হাতের লেখাতেও অন্যরকম হয়ত সচেতনেই। জেনে নেওয়া হয়নি, কারণ, প্রশ্নগুলো যখন জেগেছিল মনে, তিনি তখন অনেক দূর।
বাংলা পড়তে এবং লিখতে শেখা তাঁদের হাত ধরেই। মজার একটা ঘটনা এই ফাঁকে বলেই ফেলি।
আমাদের মাধ্যমিকের বাংলা ‘ওরাল’। ১৯৮৫ সাল, স্কুলের কোনও একটা ঘরে। প্রায় সবার শেষে ডাক পড়ল। তুষারবাবু সামনেই বসে। একাই ছিলেন বোধহয়। পরবর্তী কথোপকথন –
স্যর: এই যে বাবা কাশীনাথ, এসো বোসো। বল্ তো, তোর নাম দিয়ে কোন দেবতাকে বোঝানো হয়?
ছাত্র: (কোনও রকমে বসেছি, তার আগেই প্রশ্ন) শিব, স্যর।
স্যর: তা, সেই শিবের আরও গোটা পাঁচেক নাম বল্।
ছাত্র: মহাদেব, শঙ্কর, ভোলানাথ, নীলকণ্ঠ, মহেশ (বোধহয় এগুলোই বলেছিলাম, এত দিন পর আর মনে নেই, কিন্তু এই পাঁচটা নাম টাইপ করতে করতে মনে পড়ল, তাই লিখলাম!)
স্যর: আচ্ছা, তোর নাম আছে, রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতায়। পড়েছিস?
ছাত্র: হ্যাঁ স্যর, গানভঙ্গ।
স্যর: বল্ তো দেখি?
ছাত্র: (দুরুদুরু বক্ষে, মাত্র দুটোই লাইন জানি যে!) গাহিছে কাশীনাথ নবীন যুবা ধ্বনিতে সভাগৃহ ঢাকি/ কণ্ঠে খেলিতেছে সাতটি সুর সাতটি যেন পোষাপাখি…
স্যর: ঠিক আছে, এবার তোর নামের সমাস বল।
ছাত্র: কাশীর নাথ, ষষ্ঠী তৎপুরুষ, স্যর।
স্যর: তোর নামটার সন্ধি হয় না, তাই না?
ছাত্র: (কাঁচুমাচু) হলেও আমি জানি না স্যর…
তারপর নাম ছেড়ে পড়ার অংশে। বাকিগুলো আর মনে নেই। মিনিট দশ পর শেষে শুধু বলেছিলেন, ‘রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা’ গল্পের শেষে একটা উইল ছিল। মনে আছে, বলতে পারবি?’ আগের সব প্রশ্নগুলো মোটামুটি বলতে পারায় ছদ্ম-আত্মবিশ্বাসী হয়ে বলেই ফেললাম, পারব।
‘যদি পারিস, কথা দিচ্ছি, হায়েস্ট দেব তোকেই।’
সামান্য ছলের সাহায্য নিয়েছিলাম এখানে। গল্পটা সাধুভাষায় লেখা। আর, উইলের বিষয়বস্তুও জানাই ছিল। সাহস করে সাধুভাষায় সেটাই বলে দিয়েছিলাম। মৃদু হাসি, ধরতে পেরেছিলেন ঠিক। কিছু বলেননি আর। বেরিয়ে এসেছিলাম। মাধ্যমিকের ফল বেরনোর পর জানতে পারি, ২০-তে ১৭ দিয়েছিলেন। সর্বোচ্চ কিনা, খোঁজ নেওয়া হয়নি। আমাদের সময় তো আর ১৯ বা ২০ দেওয়া হত না। ১৭-ই অনেক ভেবে বেশ পুলকিত, এখনও, এই বছর তেত্রিশ পরও!
তা, সেই স্যর যখন রাস্তার মাঝেই ডেকে পাঠান, তা-ও আবার স্বাভাবিকের চেয়ে উঁচু গলায়, আমার মতো ভীতু ছাত্রের বুক ধড়ফড়। নিশ্চয়ই কোথাও কিছু ভুল করেছি। আমাদের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা তখন সামনেই। হয়ত দিন পনের বা সপ্তাহ তিনেক বাকি। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস স্যরের খুবই প্রিয় বিষয়। ওই বিষয়েই একটি ‘টেক্সটবুক’ও লিখেছিলেন। বইটা না পড়লে সত্যিই হয়ত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে উৎসাহ জাগত না। ভাবছিলাম, সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে কিছু বকাবকি শুনতে হবে এবার।
কোথায় কী! কাছে যেতেই নির্দেশ, ‘বাবার কাছ থেকে আমাদের মিষ্টি খাওয়ানোর টাকা নিয়ে বেরিয়েছিস তো? যা, কিনে নিয়ে আয়। বড় রসগোল্লা আনবি।’
আমার মুখ বড় রসগোল্লা ঢোকানোর মতোই হাঁ। মিষ্টি কেনার টাকা নিয়ে বেরতে যাব কেন? পরীক্ষার ফল বেরলে এবং তা আদৌ মিষ্টি খাওয়ানোর মতো হলে তা-ও নয় বুঝতাম। তখনও তো পরীক্ষাই হয়নি। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি স্যরের দিকে।
‘অবাক হচ্ছিস কেন? এত বড় একটা ব্যাপার, স্যরকে মিষ্টিও খাওয়াবি না? তোকে বাংলা লিখতে শেখাল কে? আমি তো তাঁদেরই একজন।’
আমি কিছুই বুঝিনি তখনও। ডেকে নিয়ে পাশে বসালেন। রহস্য ভাঙল তারপর। কবির সেই শান্তিনিকেতনী ঝোলা থেকে বেরল ‘দেশ’ পত্রিকা। পাতাটা বের করে চোখের সামনে তুলে জিজ্ঞাসা, ‘এই যে কাশীনাথ ভট্টাচার্য, বীরপাড়া, জলপাইগুড়ি লেখা আছে, সেটা তুই নয়? বীরপাড়ায় কাশীনাথ ভট্টাচার্য আর কে আছে রে? আমাকে মেনে নিতে হবে তুই এটা দেখিসনি?’
বিস্ময়ের শেষ নেই আমার তখন। কবে সেই একটা চিঠি লিখে পাঠিয়েছিলাম ‘দেশ’ পত্রিকায়, হোপ এইট্টিসিক্স নিয়ে। সেই চিঠিটা ছাপা হয়েছে, চোখের সামনে নিজের নাম ‘দেশ’ পত্রিকায়। এবং আমি তখনও হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দিইনি!
বাড়িতে ‘দেশ’ আসত নিয়ম করেই। হয়ত সেই দিনই এসেছিল বা আগের দিন। বীরপাড়ায় এই বইগুলো তখনও হাতেগোনা। সব বাড়িতে মোটামুটি একই দিনে দিয়ে দেওয়া হত, সেই দশবারো কপি। আসন্ন পরীক্ষার কারণেই হয়ত দেখে ওঠা হয়নি। এমনকি মা-ও দেখেনি তখনও। দেখলে তো বলতই। আমিও জানতে পারতাম।
স্যর প্রথমে রাগ করেছিলেন একটু। পরে বুঝলেন, সত্যিই দেখিনি। কারণ, স্যরের হাত থেকে বইটা নিয়ে আমি ততক্ষণে পড়তে শুরু করে দিয়েছি। এ আনন্দ রাখি কোথায়, এমন একটা ভাব। রীতিমতো উড়ছি!
মিষ্টিটা পরে স্যর বাড়ি এসেই খেয়ে গিয়েছিলেন। পরীক্ষার জন্য উৎসাহ মাস্টারমশাই দেবেন, স্বাভাবিক। কিন্তু তুষারবাবু বরাবর ভালবাসতেন অন্য কিছু চেষ্টা করলে। নেহাতই একটি চিঠি তো কী? তখন, সেই ১৯৮৭ সালে, ‘দেশ’ পত্রিকা সত্যিই বাংলা সাহিত্যসংস্কৃতির ধারকবাহক। সেই পত্রিকায় ছাত্রের চিঠি প্রকাশিত হয়েছে, মাস্টারমশাইয়ের আনন্দ যেন ছাত্রের চেয়েও বেশি।
অস্বীকার করছি না, নিজেরও বেশ ভালই লেগেছিল। ছাপার অক্ষরে নাম সেই প্রথম। আমি তখনও অনূর্ধ্ব-১৭। ‘খেলা’ পত্রিকায় তারপর অনেক চিঠি লিখেছিলাম। কিন্তু, শুরুটা ‘দেশ’-এ। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে, বেশ বড়সড় প্রাপ্তি আমার।
তেত্রিশ বছর আগের ঘটনা। দেশ পত্রিকা, ‘আন্ডার সেভেনটিন’ এবং প্রিয় স্যরের উৎসাহ - ভাবতে বেশ লাগছে এখন...
** অললই এবং তুষারবাবুর হাতের লেখার ছবি পার্থ পাঠিয়েছিল, স্যরের ছেলে বুম্বার (অনন্য) থেকে নিয়ে। পার্থকেও অজস্র ধন্যবাদ 🙂

Monday, February 17, 2020

খেলা-য় প্রকাশিত প্রথম চিঠি / কাশীনাথ ভট্টাচার্য

১৯৮৭ সালের ৯-১৫ অক্টোবর সংখ্যা,
খেলা-য় প্রকাশিত প্রথম চিঠি
সুনীল গাভাসকার তখন আমাদের আরাধ্য। খুব সম্ভবত ‘খেলা’ পত্রিকা নিয়মিত পড়ার কারণেই।
কলকাতা থেকে প্রায় সাতশো কিলোমিটার দূরের বীরপাড়া চা-বাগানে থাকার কারণে আমরা বরাবরই পিছড়েবর্গ! দৈনিক কাগজ আসত সন্ধেবেলা। তা-ও, আগের দিনের। মানে, সোমবার সকালে যে কাগজ প্রকাশিত হয়েছিল কলকাতায়, মঙ্গলবার বিকেলে বীরপাড়ার বাড়িতে পৌঁছত। আমাদের কিছুই যেত-আসত না। রোজ সকালে উত্তরবঙ্গ সংবাদ তখনও মাথা তোলেনি এতটা। ওই ‘বাসি’ খবরের কাগজ পড়তে অভ্যস্ত ছিলাম সন্ধেয়। স্কুল থেকে ফিরে খেলার মাঠ। তারপর বাড়ি এসে সান্ধ্য টিফিনের সঙ্গে কাগজ-পড়া। বরঞ্চ, মাঝেমাঝে কলকাতায় এলে সকালে কাগজ দেখে কেমন যেন লাগত। এমনও হয় বুঝি!
কিন্তু ‘খেলা’ পত্রিকা ঠিক সময় না পেলে কী যে রাগ হত! শুধু ‘খেলা’-ই বা কেন, আনন্দমেলা, শুকতারা, কিশোর ভারতী ইত্যাদি সব পত্রিকাই নির্দিষ্ট দিনে তপুদার ‘পকিশা’-য় না এলেই মন খারাপ।
লিট্টু (তথাগত দাস) পড়ত এক-ক্লাস উঁচুতে। পাড়ায় এমন পরিস্থিতিতে যা হয়, কখনও দাদা বলার সুযোগই হয়নি! অনেকগুলো মিল। মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, ভাস্কর গাঙ্গুলি, ইস্টবেঙ্গল, ব্রাজিল, জিকো, প্লাতিনি। শব্দজব্দ করতে ভালবাসতাম তখন, দুজনেই। টুয়েলভের অঙ্কে দুজনেরই বড্ড প্রিয় ছিল ক্যালকুলাস। লিট্টুদের দোকানে বসেও কত অঙ্ক করেছি। ও যেহেতু সিনিয়র, আরও ভাল পারত। আর লিট্টুর মগজ চলত আলোর গতিতে। দাবায় ওকে কখনও হারাতে পেরেছি, মনে পড়ছে না। ক্যারমে হারিয়েছি অনেকবারই। খেলার কুইজ জাতীয় প্রশ্নের জবাবে ওর স্পিড সেই আটের দশকে কপিলের মতো। এমনকি, ব্যাট করতে নামত যখন, খেলতও কপিলের ঢঙে।
দাদু (মায়ের বাবা) কলকাতা থেকে একেবারে ‘অরিজিনাল’ ব্যাটের মতো একটা ব্যাট নিয়ে গিয়েছিলেন একবার। তাতে আবার কপিলদেবের ছবি। ওই ব্যাটটা কী যে প্রিয় ছিল লিট্টুর! তার আগে আমাদের ব্যাট বলতে চ্যালাকাঠ। ছুতোরের কাছে গিয়ে ব্যাটের আদল করে-নেওয়া। তার দৈঘ্য-প্রস্থ-বেধ কোনওটাই এমসিসি-র নিয়ম মানে না। বয়েই গেল! আমরা তো রোজ বিকেলে ওই ব্যাটগুলো দিয়েই টেস্ট ক্রিকেট খেলতাম, পাঁচ-ছ’দিন ধরে। রাবার ডিউস বলে ওই কপিলদেবের ছবিওয়ালা ব্যাটটা দিয়ে লিট্টু কী জোরে জোরে মারত! অবিকল নটরাজ ভঙ্গিতে। ক্লাস এইট-উত্তর ডিউসে এসেও ওর সেই স্বভাব যায়নি। অথচ, গাভাসকারের অন্ধভক্ত! ক্লাইভ লয়েড কবে বলেছিলেন মনে নেই, আমরা দুজন, বন্ধুদের সঙ্গে তর্কে প্রায়ই বলতাম, ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনালে স্লিপে গাভাসকার ক্যাচদুটো না নিলে কপিলের হাতে কি ওয়ার্ল্ড কাপ উঠত?
নানারকম কাগজ-পেন ইত্যাদি নিয়ে লিট্টুদের একটা দোকান হল। দাস পেপার এজেন্সি গোছের নাম ছিল, ঠিক মনে নেই। সন্ধেবেলা লিট্টুকে বেশ খানিকক্ষণ থাকতে হত দোকানে। খেলা শেষ করেই ছুটত। সান্ধ্যকালীন ধূপধূনো দিতে হবে বলে। আমিও চলে আসতাম পেছন-পেছন। কোনও এক ঠাকুরের ছবি ছিল ক্যালেন্ডারে। আমরা সেই ক্যালেন্ডারের পেছনে লাগিয়েছিলাম গাভাসকারের বড় ছবি, দেওয়ালে, সেলোটেপ দিয়ে। ধূপ দেখানোর সময় লিটটু ওই ক্যালেন্ডারটা একটু তুলে পেছনে ছবিটার সামনেও দুবার ঘুরিয়ে নিত। এতটাই পাগলামি ছিল আমাদের।
সেই গাভাসকার, বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ জানালেন, অবসর নিচ্ছেন। আমাদের তো মাথায় বাজ! সাদা-কালো টেলিভিশনে অ্যান্টেনার অঙ্গুলিহেলনে ঝিরিঝিরি ছবি দেখা মাথায়। ধুস্, আর ক্রিকেট দেখে হবেটা কী! আমরা দুজনেই প্রায় বিবাগী তখন। সবই করছি, খাপছাড়া।
সেই ‘খেলা’-র প্রচ্ছদ

লিট্টুই বলল এক দিন, ‘খেলায় একটা চিঠি লেখ্ তো। খেলা-সম্পাদক যেমন ভক্ত গাভাসকারের, আমাদের চেয়েও বেশিই হবেন - ঠিক ছেপে দেবেন।’ তখনও বিশ্বাস করতাম, সম্পাদকই চিঠিপত্র পড়ে সিদ্ধান্ত নেন কোনটা ছাপা হবে। চূড়ান্ত গাঁইয়া, থুড়ি, চাবাগানিয়া!
যেমন কথা তেমন কাজ। কাগজ-কলম নিয়ে বসে পড়েছিল দুই কিশোর। ভাবনা দুজনের, লিখেছিলাম আমি। ওর পরামর্শেই ডাকনাম দিয়ে চিঠি শেষ। ফেলে দেওয়া হল ডাকবাক্সে। ভারতীয় ডাক ও তার ব্যবস্থার হাতে গুরুভার, আমাদের চোখের জলে প্রায় ভিজে-যাওয়া খামটাকে ঠিকঠাক পৌঁছে দিতে হবে কলকাতা ৯-এর ৯৬ রাজা রামমোহন সরণিতে। শুরু অপেক্ষা।
কতদিন পর চিঠিটা ছেপে বেরিয়েছিল, এখন আর মনে নেই। কিন্তু ‘খেলা’ পত্রিকায় দুই প্রিয় বন্ধুর নাম একসঙ্গে, ছাপার অক্ষরে, দেখার আনন্দে পাগল-পাগল অবস্থা। কপিলভক্তদের ডেকে ডেকে পড়াচ্ছি, আর ওদের পকেট ঝেড়ে সিগারেট খাচ্ছি। কী সব দিন, আহা রে
লিখতে লিখতে মনে হচ্ছে, তোর সঙ্গে যদি আর একবার এটা নিয়ে কথা বলতে পারতাম রে, লিট্টু … কী অভিমানে যে কোথায় চলে গেলি…

Saturday, February 15, 2020

কাকুর টেবিলে / কাশীনাথ ভট্টাচার্য




কাশীনাথ ভট্টাচার্য
মাধ্যমিক দেব, ক্লাস টেন বলে কথা, কপালের ওপর চুল পড়েছে সবে মিঠুন চক্রবর্তীকে দেখে, সন্ধেবেলা ভূগোল পড়া বলতে গিয়ে আটকে গেলাম দামোদর নদী পরিকল্পনায়, 'বহুমুখী প্রতিভা তোর' ছোট্ট মন্তব্য বোঝাল চুলের সিঙ্গারা-টা এসেছে নজরে। শ্রী বিদ্যুৎ (ভানু) ঘোষের নজর এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই যে !
ছুটি দিয়ে দিতেন আমাকে আর বিশুকে, আটটায়। বাড়ি গিয়ে একটু বিশ্রাম। খেয়েদেয়ে সাইকেল চালিয়ে কাকুর বাড়ি, দশটায়... শম্পা-টুঙ্কা-ঝুম-সোমা, ছাত্রীদের তখন ছুটি হত। আমরা টেস্ট পেপারের দুটো গ্রামার আর অঙ্কের দুটো ছোট প্রশ্নের কাজ নিয়ে দোতলায় আবার। কাকু খেয়েদেয়ে এক গ্লাস দুধ আর চারমিনারের প্যাকেটটা নিয়ে আবার ওপরে, এগারটা নাগাদ। আমাদের পড়া চলত একটা-দেড়টা পর্যন্ত... ঘুম আসছে, 'দুটো উৎপাদক আর দুটো সমাধান করেনে, চলে যাবে', অব্যর্থ দাওয়াই !
রাত দেড়টায় বাড়ির সামনে টিংটিং সাইকেলের ঘন্টি। মা বেরতেই 'আপনার ছেলেকে দিয়ে গেলাম।' বলেই এক মুহূর্তও দাঁড়ানোর ফুরসত নেই, বিশুর বাড়িতেও যে এক-ই কাজ করতে হবে! পরের সকালেই আবার ছাত্র পড়িয়ে ব্যাঙ্কের বড়বাবুর কাজ এবং গোটা বীরপাড়ার অনুরোধের আসর হাসিমুখে সামলানো...
লোডশেডিং হলে আর রক্ষে নেই। দোতলায় যে-ঘরটায় পড়াতেন আমাদের, পেছনের দেওয়ালে একটা তাক ছিল, যেমন থাকে আমাদের ও দিকে সব বাড়িতেই। তাতে নানারকমের বই। আমাদের সবচেয়ে ভয়ের ছিল, জীবন বিজ্ঞান আর ইতিহাসের টেন টিচার্স গোছের বইদুটো। কাকুর সামনে মোমের আলোয় আমাদের অন্ধকার ভবিষ্যৎ উঁকি মারছে!! কী সব প্রশ্ন, একটারও উত্তর জানি না। কিন্তু কাকু কখনও ধরতে ভোলেনি। এখন বুঝি, ওভাবেই এগিয়ে দিতেন, প্রস্তুত হতাম অনাগত ভবিষ্যতের জন্য।
লোডশেডিংয়ের আরও এক দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা ছিল ‘পুরনো পড়া’। কাকুই বোধহয় একমাত্র যিনি ইতিহাস-ভূগোল না-পড়লে ‘পড়াব না’ বলতেন। এই না-পড়লেটা যে আদতে কী, আমরা, যাকে ইংরেজিতে বলে ‘বোন-টু-বোন’ জানি! রোজ পড়া দিতেন পাতা দেড়-দুই। এবং আমাদের পড়া শুরু হত যে কোনও একটা বই টেনে নিয়ে কাকুর মুখে ‘বল্’ শুনে। সোজা বাংলায় - গড়গড় করে বলে যা। না বলতে পারলে কী শাস্তি সেটা নির্ভর করত সেই দিনের মেজাজ এবং অন্যান্য বিষয়ের পারফরম্যান্সের ওপর। নিশ্চিত থাকতেই হত, বছরে যে তিন-চারদিন বাড়িতে সন্ধেবেলা লুচি-আলুর দম বা পরোটা-মাংস খেতে আসবেন, মায়ের কানে ঠিকই তুলে দিয়ে আসবেন, সেই দিনের পড়া বলতে না-পারার ঘটনাটা। ফলে, তিনি চলে যাওয়ার পর শুরু হবে মায়ের হাতের দ্বিতীয় পর্ব!
তো, লোডশেডিং হলেই ইতিহাস-ভূগোল বইয়ের সামনের দিকে। মানে আজকের পড়া ছিল হয়ত ৪৮ পাতায়, চলে গেলেন আটের পাতায়। ‘বল্’! কী বলব, কী করে বলব? ‘আরে এই তো ১৩ জানুয়ারি দিয়েছিলাম পড়া, আজ সতেরই মার্চ, ভুলে গেলি? তা হলে পরীক্ষার সময় কী লিখবি, কী করে লিখবি?’ হ্যাঁ, যে দিন যে-পড়াটা দিচ্ছেন, বইতে পেনসিল দিয়ে ছোট করে ডেটটা লিখে রাখতেন। তাই সহজেই বলতে পারতেন, কোন দিন কী পড়া দিয়েছিলেন। ওই এক লোডশেডিংয়ের ভয়ে রীতিমতো রিভাইজ চলত নতুন পড়ার সঙ্গেই পুরনোরও। কী করে সময় বের করতাম, এখন মনে নেই। কিন্তু, সেই জমানায় লোডশেডিং এতটাই কমন ছিল যে, কাকুর আনকমন প্রশ্নগুলো ট্যাকল করতে হবে ভেবেই প্রস্তুতি নিতে হত আমাদের। না হলে যে কাকুর শাসনের সঙ্গে মায়ের ঠ্যাঙানি নিশ্চিত। ওই ডবলডেকার শাস্তির ভয়ে তৈরি থাকতে গিয়ে দেখতাম, লাভ হত পরীক্ষার সময়, ততটা দেখতে হত না। সরাসরি না-বলেই তৈরি করে দিতেন এভাবেই।
মাধ্যমিকের অঙ্ক পরীক্ষায় এক্সট্রা-টা হয়নি। পরের দিন সকালে প্রশ্ন দেখাতে গিয়েছি, বললেন, "এটা পারিসনি!' কন্ঠে অবিশ্বাস, রাগ নেই এক ফোঁটাও। 'দ্যাখ আর একবার' বলে ঘর থেকে বেরিয়েছেন, আমার হয়ে গেল... হুহু করে কাঁদছি, বুকে টেনে নিলেন। 'পরীক্ষার হলে এমন অনেক কিছু হয়, হবেও, ঠিক আছে চল। গাভাসকার একবার বোল্ড হলে কি পরের বার ব্যাট করতে নামে না?'
আমাদের কালে "টিচার্স ডে" ছিল না। কখনও কোনও মাস্টারমশাইকে কিছু দিয়েছি, এ-অভিযোগ কেউ করতে পারবেন না! একটা পেন, একটা কার্ডও দেওয়া হয়নি। ভালবাসা কমেনি তাতে যেমন, ভয়ও কমেনি, এখনও...
কাকুর বাড়ি গেলেও ওপরের ঘরের টেবিলটা দেখতে যেতে পারি না তাই। কেমন একটা ছমছমে ভাব, আবার, তুমুল আবেগও ঘিরে ধরে। কাকিমা যত দিন ছিলেন, মাঝেমাঝে শুধু জেনে নিতাম, ‘টেবিলটা আছে তো কাকিমা?’ একগাল মিষ্টি হেসে কাকিমা বলতেন, ‘থাকবে না? তোদের সব তো ওখানেই।’ কাকুর কাছে আর বোধহয় জানতে চাইনি।
যা বা যতটুকু আছে মনে, থেকে যাক, টেবল টেনিসের টেবিলের মতো বড়, দোতলার পড়ার ঘরের ওই টেবিলটায়, আমাদের বেড়ে ওঠার হাজারখানেক স্মৃতির জীবাশ্মসহ... 🙏
প্রণাম নেবেন কাকু। সুস্থ থাকুন, খুব ভাল থাকুন।

(সেপ্টেম্বর ৫, ২০২০)