Friday, October 13, 2023

কাশীনাথ ভট্টাচার্য / প্রতিবন্ধক-ইডেন!


স্টোরিটা কাতার থেকে করেছিল বর্তমানের সোমনাথ বসু। বলামাত্রই পাঠিয়ে দিল, ধন্যবাদ দিয়ে ওকে ছোট করব না। প্রিন্ট মিডিয়ার এটাই সুবিধা, চাইলেই পাওয়া যায়, পড়া যায়, লিপিবদ্ধ রাখাও যায়, সহজে। এমন স্টোরিই তো লিখে রাখতে হয় রে সোমনাথ!

কাতার বিশ্বকাপের আসরে গিয়ে দেখা পেয়েছিলাম নিকোলাস দানিয়েল রোদরিগেস-এর। দোহার মিডিয়া সেন্টারে। হুইল চেয়ার নির্ভর সাংবাদিক প্রেস সেন্টারে দেখতে পাওয়া যায় না সচরাচর। তার ওপর ফিফা বিশ্বকাপে যেখানে এত ঘোরাঘুরি, হাঁটাহাঁটি। ফিট না থাকলে ওই ৩৪-৩৫ দিনের ধকল সামলানোটাও সহজ নয়। নিকোলাস আবার এসেছিলেন মোনতেভিদিও থেকে কাতারে। দূরত্ব, গুগল জানাল, তের হাজার একশো সতের (১৩,১১৭) কিলোমিটার!

সে না হয় বিমানে এলেন। বিমানে হুইল চেয়ার তোলা-নামানোর ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু, তারপর?

প্রতিটি স্টেডিয়ামে যাওয়ার জন্য ফিফা বাস দিয়েছিল। মিডিয়া সেন্টার থেকে সেই বাস ছাড়ত এবং পৌঁছনো যেত স্টেডিয়ামে। সেখানে নেমেও কতটা যে হাঁটতে হত, যাঁরা গিয়েছিলেন, জানেন। নিকোলাসের সঙ্গী ছিলেন এসিলদো (Hesildo)। আরও এক সাংবাদিক, যিনি প্রতি পদে বন্ধুকে নিয়ে হেঁটেছিলেন, বন্ধুর বিশ্বকাপ ফুটবল দেখা ও লেখার আনন্দ ভাগ করে নিয়েছিলেন সর্বদা পাশে থেকে, হুইলচেয়ার ঠেলে। কুর্নিশ তাঁকেও। এমন বন্ধুত্বও ভাবায়, অনুপ্রেরণা জোগায়।

ফিফাকে ধন্যবাদেরও ভাষা নেই, বিশেষভাবে সক্ষম নিকোলাসকে বিশ্বকাপের অ্যাক্রিডিটেশন দিতে দ্বিধা করেনি বলে। বিশেষভাবে সক্ষম হওয়া, চলাফেরায় অসুবিধা, নিকোলাসের দেখা এবং লেখার প্রতিবন্ধক ছিল না। তাই দেওয়া হয়েছিল অ্যাক্রিডিটেশন। তাঁর সমস্যার সমাধান করেছিলেন নিকোলাস, তাঁর মতো করে, পাশে এসিলদোকে পেয়ে।

তবুও, এই সবই সম্ভব হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ, স্টেডিয়ামের মিডিয়া সেন্টার এবং প্রেস বক্স বা প্রেস গ্যালারিতে পৌঁছতে লিফটের সুবন্দোবস্ত। পাঁচ-ছ’তলার কম কোনওটাই নয়, সিঁড়ি বেয়ে নিকোলাসকে নিয়ে যাওয়া সম্ভবই ছিল না। যদি তেমন হত, নিকোলাস কোনও ম্যাচই দেখতে পেতেন না, প্রেস সেন্টারে যাওয়ার সুযোগ পেতেন না।

আমার বর্তমান পায়ের অবস্থায় তাই মনে পড়ল নিকোলাসের কথা।

পায়ে প্লাস্টার নিয়ে আমার পক্ষে এখন ইডেনের প্রেস বক্স বা মিডিয়া সেন্টার, কোত্থাও যাওয়া সম্ভবই নয়! দু’জায়গাতেই পৌঁছতে হয় সিঁড়ি বেয়ে। লিফট নেই। অর্থাৎ আমি যদি হুইল চেয়ার কিনে গাড়িভাড়া করেও ইডেনে পৌঁছে যাই, আমার পক্ষে প্রেস বক্সে বসে ম্যাচ দেখা-লেখা সম্ভব হবে না। সিএবি-র দোতলা পর্যন্ত একটা লিফট আছে আধিকারিকদের জন্য। সেটা এই অবস্থায় আমাকে ব্যবহার করতে দিতে কেউই আপত্তি করবেন না, জানি। মিডিয়া-নির্দিষ্ট গেট থেকে সেই লিফট ব্যবহারের জায়গায় যেতে পারা যায় না অন্যসময়, এখন আমার অবস্থা দেখে সেটাও সমস্যা হবে না। কিন্তু তারপরও যত সিঁড়ি ভাঙতে হবে, হুইলচেয়ার নিয়ে সম্ভব নয়। হুইলচেয়ার চালানোর, টেনে তোলা বা নামানোর মতো কোনও ব্যবস্থাই যে নেই!

হ্যাঁ, এত কষ্ট করে ম্যাচ দেখতে যাওয়ার কী আছে, প্রশ্ন আসবেই। আমি যাচ্ছি না, যেতে চাইছিই না, কারণ খুব ভাল করে জানি যে, অসম্ভব! যেখানে লেখার কথা, জানিয়ে দিয়েছি, পারছি না আপাতত। মেনে নিয়েছেন। সমস্যা কোত্থাও নেই।

তবুও প্রশ্নগুলো থাকছে। পায়ে ভর দিয়ে চলতে পারছি না অ্যাক্সিডেন্টের কারণে। আমার মাথা-হাত, অন্য পা, চোখ সব ঠিক আছে। দেখতে, লিখতে কোনও অসুবিধা নেই। বাড়িতে বিছানায় বসে তো লিখেই চলেছি নিয়মমতো। আমি যেহেতু খেলতে নামছি না, এই নিজে নিজে চলতে না-পারাটা কোনও অর্থেই আমার ম্যাচ দেখা এবং লেখার প্রতিবন্ধক নয়। নিকোলাসের সমস্যাগুলোর কাছাকাছিই নয়, কোনওভাবেই। তবু নিকোলাস পেরেছিলেন ফিফা বিশ্বকাপে কাতারে হাজির থাকতে, উরুগুয়ে থেকে এসে আর আমি যেতে পারব না আইসিসি বিশ্বকাপের খেলা দেখতে মাঠে, নিজের শহরে, বিশ্বকাপের অ্যাক্রিডিটেশন থাকা সত্ত্বেও!

এমনটা না হলেই ভাল হত না প্রিয় ইডেনে?