Wednesday, September 30, 2020

কাশীনাথ ভট্টাচার্য / বৈচিত্র্যের রানির রাজপাট বাংলাতেও

বাংলা সিনেমার গানে বোম্বে, তৃতীয় পর্ব – আশা ভোঁসলে

লতা মঙ্গেশকারের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, গায়িকা আশা ভোঁসলে ঠিক কোন কোন দিকে এগিয়ে, ‘স্ট্রং পয়েন্ট’ কী কী?

নাসরিন মুন্নি কবীর-কে বুঝিয়ে বলেছিলেন ‘লতা মঙ্গেশকার ইন হার ওন ভয়েস’ বই-তে ‘দিদি’ লতা – ‘‘বৈচিত্র‌্য। যে কোনও ধরনের গান দিন ওকে, খুব ভাল গেয়ে দেবে। সে দুঃখের গান হোক বা হাসির, রোমান্টিক বা নাচের গান। আমার বোন বলে বলছি না, ওর গুণের কথা বলা তো আমার কর্তব্যও। যত ধরনের গান আশা গেয়েছে, মনে হয় না কারও সঙ্গে ওর তুলনা করা সম্ভব। যখন এসেছিল ইন্ডাস্ট্রিতে, একদম অন্যরকম গাইত। পরে বর্মনদার প্রভাব পড়ে ওর ওপর, নিজেকে আরও এগিযে নিয়ে যায়। বর্মনদার একটা স্টাইল ছিল, গানের কোনও লাইনে একটি কথার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া। যেমন, ‘মেরে বন যাও’–তে যাও’–এর ওপর। বাংলা লোকগীতি থেকে এই স্টাইলটি এনেছিলেন বর্মনদা। ও পি নায়ারও পরে এই স্টাইলটি রপ্ত করেছিলেন। হাওড়া ব্রিজ ছবিতে আশার আইয়ে মেহেরবানগানটা মনে পড়ছে? যেভাবে আইয়েশব্দটার ওপর বিশেষভাবে জোর দিয়েছিল, অনবদ্য। ও পি নায়ারের গানও খুব গাইত আশা। নায়ার সাহেব বরাবরই শামসাদ বেগম, গীতা দত্ত, কিশোর কুমার আর রফি সাহেবকে পছন্দ করতেন, ওঁর সুরে গান গাওয়ার জন্য। মনে করতেন, ওঁর সুর ঠিক আমার গলার জন্য নয়। আমারও বিশ্বাস, ঠিকই করতেন। ওঁর কম্পোজিশনগুলো ঠিক আমার জন্য নয়।’’

তাই বৈচিত্র্যের রানি আশা হিন্দির মতো বাংলাতেও রাজপাট সাজিয়ে বসেছিলেন নিজের মতো করেই। পাঁচের দশকের শেষ দিকে বাংলা ছবিতে আগমন। প্রথম গান, খুঁজে যা পাওয়া যাচ্ছে সালের হিসাবে, সম্ভবত, ‘গলি থেকে রাজপথ’ সিনেমায়, ১৯৫৯ সালে। ‘কে গো তুমি ডাকিলে আমারে’গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায়, সুধীন দাশগুপ্তর সুরে। পরে যে জুটিতে আরও বহু স্মরণীয় গান গাইবেন আশা। আর, পর্দায় সে গান গেয়েছিলেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়।

ছয়ের দশক ছেড়ে দিন, সাতের দশক থেকে কিন্তু প্রায় বছর কুড়ি আশা রাজত্ব করেছেন বাংলা ছবির গানে। আর সেখানে পথিকৃৎ বলা যেতেই পারে সুধীন দাশগুপ্তকে। বড় ভাল ভাল গান গাইয়েছিলেন আশাকে দিয়ে আলাদা করে বলার নেই বাঙালি শ্রোতাকে, কিছু গানের কথাই যথেষ্ট। ডেকে ডেকে চলে গেছি, কোন সে আলোর স্বপ্ন নিয়ে (প্রথম কদম ফুল, ১৯৭০); আমার দিন কাটে না, আরও দূরে চলো যাই (ছদ্মবেশী, ১৯৭১); আজ দুজনে মন্দ হলে (ফরিয়াদ, ১৯৭১); কেন সর্বনাশের নেশা ধরিয়ে, মন মেতেছে (পিকনিক, ১৯৭২); সাগর ডাকে আয় (জীবন সৈকতে, ১৯৭২); আমি অন্ধকারের যাত্রী (এপার ওপার, ১৯৭৩) এর মধ্যে আবার প্রথম কদম ফুল নিয়ে অন্য গল্প শোনা গিয়েছে। সুধীন নাকি চেয়েছিলেন ‘কোন সে আলোর স্বপ্ন নিয়ে’ গাইবেন লতা! দেখা করতেও গিয়েছিলেন লতার সঙ্গে। সেই দিন, কোনও কারণে, ‘দিদি’ ছিলেন না প্রভু কুঞ্জে। ‘বোন’ আশার সঙ্গে কথা হয়, ‘ডেকে ডেকে’ নিয়ে। দিদির কোন গানটা, জানতে চেয়েছিলেন আশা। শুনে নাকি বলেছিলেন, গাইলে দুটি গানই গাইবেন, না হলে একটাও নয়। অগত্যা, কী-ই বা করতে পারতেন আশার ‘সুধীনদা’ তখন!

যদি কানে কানে কিছু বলে বঁধুয়া

বাংলা ছায়াছবিতে আশার জনপ্রিয়তা বেড়ে যাওয়ার অবশ্যই বড় কারণ রাহুল দেব বর্মনকিন্তু তারও আগে শ্যামল মিত্রর নাম নিতেই হবে রাহুল যখন অনুসন্ধান ছবিতে ‘আমার স্বপ্ন যে সত্যি হল আজ’-এ কিশোরসঙ্গী করেছেন লতাকে, শ্যামল কিন্তু তার আগে কিশোরের সঙ্গে আশার ডুয়েট করে ফেলেছেন ‘আমার স্বপ্ন তুমি ওগো চিরদিনের সাথী’ গানে, আনন্দ আশ্রম ছবিতে, ১৯৭৭ সালে। সবচেয়ে বড়, শ্যামল মিত্রর সুরে আশার যেখানে বাংলা ছবিতে অসংখ্য মনভোলানো গান, লতার নেই-ই। সেই ‘নেই সেই পূর্ণিমা রাত’ দিয়ে শুরু। ১৯৭৬ সালে অজস্র ধন্যবাদ ছবির সব গানই ফিরত লোকের মুখে-মুখে। ববি-খ্যাত শৈলেন্দ্র সিংকে নিয়ে এসেছিলেন শ্যামল, ‘নদী যদি বলে সাগরের কাছে আসব না’ যেমন মনে রেখে দিয়েছেন বাঙালি শ্রোতা, আশার ‘প্রেম কথাটাই ছোট’ গানটিও। আলাদা উল্লেখ এই জন্যই যে শ্যামলের নিজের ছায়া ঝরা ভরা সাঁঝে এবং তুমি যে আমারই গান-ও এই একই ছবির, দ্বিতীয় গানটি আবার সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ও গেয়েছিলেন। তারই মাঝে এই দুটি গান এবং আশা-শৈলেন্দ্রর দ্বৈত ‘কাছে আছ তুমি’ আলাদা করে মনে থেকে যাওয়াও বড় সাফল্য।

পরে শ্যামলের সুরে আরও কত গান! জানি না আজ যে আপন, না না না না এমন করে (অমানুষ ১৯৭৫), ভালবেসে ডেকেই দেখো না (আনন্দ আশ্রম, ১৯৭৭); আমি কে সে কি ভুলে গেলে, নেশা তুমি যতই করো (কলঙ্কিনী, ১৯৮১); কুঞ্জবিহারী হে গিরিধারী (মায়ের আশীর্বাদ, ১৯৮২)। জয়যাত্রা শুরু যেন তাঁর হাত ধরেই পরে, একান্ত আপন, ত্রয়ী বা তিনমূর্তি-তে পঞ্চম স্বাভাবিকভাবেই আশা ছাড়া অন্য কারও দিকে তাকাননি

আটের দশকে একটি ছবি এসেছিল, দীপঙ্কর দে ও অপর্ণা সেন জুটিতে, মোহনার দিকে সুরকার ছিলেন আরডি-র একসময়ের সহকারী স্বপন চক্রবর্তী ছবিতে মোট ছটি গান, একটি কিশোর কুমারের, ‘নাই নাই এ আঁধার থেকে ফেরার পথ নাই বাকি পাঁচটি গান আশারআছে গৌর নিতাই নদীয়াতেসব পুজো প্যান্ডেলে যদিমাস্টহয়ে থাকে, ‘কে যেন আবীর ছড়িয়ে দিল ভোরের আকাশেএবংরামধনু রঙ নিয়ে আমি খেলাঘর বেঁধেছি’, গানদুটি শুনলেই মনে হয় সুরারোপ করেছিলেন আরডি স্বয়ং! আর লালকুঠি ছবিতে স্বপন-জগমোহনের সুরেও আশাই, ‘তারে ভোলানো গেল না কিছুতেই’!

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রক্সিতে সবাইকে দিয়েই একটি করে দুরন্ত গান গাইয়েছিলেন। আশার ‘যখন তোমার গানের সরগম’ অন্যতম। বিশেষভাবে মনে করা যেতে পারে ভূপেন হাজারিকার সুরে চামেলি মেমসাহেব ছবিতে ‘কখগঘ চছজঝ এবিসিডি নিয়ে গো’। ছবি ততটা সফল না হলেও কখগঘ-র সাফল্য প্রশ্নাতীত। যেমন, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ও ‘যদি কানে কানে কিছু বলে বঁধুয়া’ গাইয়েছিলেন জীবন রহস্য ছবিতে।

শেষ দিকে আরডি থাকাকালীন এবং আরডি-র পর, বাপি লাহিড়ি বেছে নিয়েছিলেন আশাকে, একই রকম চমকপ্রদ কিছু গানের ক্ষেত্রে। বরাবরই আশা নতুন প্রজন্মের সুরকারদের সঙ্গে সমান স্বচ্ছন্দ্য। এখনও তিনি নতুন কোনও গান করে ফেলবেন না, নিশ্চয়তা দেওয়া যায় কি? আর, তিনি গাইলে সেই গানের আকর্ষণ এবং আবেদন অন্য স্তরে পৌঁছবেই, সে-ও তো নিশ্চিত!

 

আশা ভোঁসলে (বাংলা ছায়াছবির জনপ্রিয় কিছু গান)

সুরকারশ্যামল মিত্র

নেই সেই পূর্ণিমা রাত (রাজকন্যা, ১৯৬৫); যদি হই চোরকাঁটা ওই শাড়ির ভাঁজে (কিশোর), জানি না আজ যে আপন, না না না না এমন করে (অমানুষ ১৯৭৫); কাছে আছ তুমি (শৈলেন্দ্র), নওল কিশোর শ্যামসুন্দর (শৈলেন্দ্র, রফি, শ্যামল), প্রেম কথাটাই ছোট (অজস্র ধন্যবাদ, ১৯৭৬); আমার স্বপ্ন তুমি ওগো (কিশোর), ভালবেসে ডেকেই দেখো না (আনন্দ আশ্রম, ১৯৭৭); আমি কে সে কি ভুলে গেলে, কোনও কাজ (কিশোর), একই সাথে হাত ধরে (কিশোর), নেশা তুমি যতই করো (কলঙ্কিনী, ১৯৮১); কুঞ্জবিহারী হে গিরিধারী (মায়ের আশীর্বাদ, ১৯৮২)

সুরকাররাহুল দেববর্মন

গুন গুনগুন কুঞ্জে আমার (কিশোর), বন্ধ ঘরের অন্ধকারে, সে কি এল (রাজকুমারী, ১৯৭০); ফুলকলি রে ফুলকলি (কিশোর, অনুসন্ধান, ১৯৮০); আধো আলো ছায়াতে (কিশোর), ও আমার কাঁধের আঁচল (কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী, ১৯৮১); জানা অজানা পথে চলেছি (কিশোর, আরডি), আরও কাছাকাছি (কিশোর), একটু বোসো চলে যেও না, কথা হয়েছিল (ত্রয়ী, ১৯৮২); বান্দার সেলাম নাও জনাব (আরডি), নতুন সে তো নতুনই (কিশোর), জানো যদি এ মন কী চায় (তিনমূর্তি, ১৯৮৪); নাগর আমার কাঁচা পিরীত (শৈলেন্দ্র, অন্যায় অবিচার, ১৯৮৫); না না কাছে এসো না (এসপি), এমন মধুর সন্ধ্যায়, হায়রে কালা এ কী জ্বালা, তোলো ছিন্নবীণা, খেলব হোলি রঙ দেব না (একান্ত আপন, ১৯৮৭); শ্যাম ঘনশ্যাম তুমি (আগুন, ১৯৮৮)

সুরকারসুধীন দাশগুপ্ত

ডেকে ডেকে চলে গেছি, কোন সে আলোর স্বপ্ন নিয়ে (প্রথম কদম ফুল, ১৯৭০); আমার দিন কাটে না, আরও দূরে চলো যাই (ছদ্মবেশী, ১৯৭১); আজ দুজনে মন্দ হলে (ফরিয়াদ, ১৯৭১); কেন সর্বনাশের নেশা ধরিয়ে, মন মেতেছে (পিকনিক, ১৯৭২); সাগর ডাকে আয় (জীবন সৈকতে, ১৯৭২); আমি অন্ধকারের যাত্রী (এপার ওপার, ১৯৭৩)

সুরকারহেমন্ত মুখোপাধ্যায়

মেঘের কোলে রোদ হেসেছে (রবীন্দ্রসঙ্গীত, কুহেলি, ১৯৭১); যখন তোমার গানের সরগম (প্রক্সি, ১৯৭৭)

সুরকারঅভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

যদি কানে কানে কিছু বলে বঁধুয়া, ও পাখি উড়ে আয় (জীবন রহস্য, ১৯৭৩)

সুরকারনচিকেতা ঘোষ

পাগলা গারদ কোথায় আছে (মান্না), বেশ করেছি প্রেম করেছি (মৌচাক, ১৯৭৪); আলো আর আলো দিয়ে (স্বয়ংসিদ্ধা, ১৯৭৫)

সুরকারশচীন দেব বর্মন

গুঞ্জনে দোলে যে ভ্রমর (কিশোর, আরাধনা, ১৯৭৬)

সুরকারভূপেন হাজারিকা

কখগঘ চছজঝ (চামেলি মেমসাহেব, ১৯৭৮)

সুরকারস্বপন-জগমোহন

ঢলে যেতে যেতে (কিশোর), কে যায় রে, তারে ভোলানো গেল না (লালকুঠি, ১৯৭৮); জাফরানি রঙ আকাশে (প্রহরী ১৯৮২)

সুরকারবীরেশ্বর সরকার

এক যে ছিল রাজপুত্তুর (কিশোর, মাদার, ১৯৭৯)

সুরকারবাপি লাহিড়ি

তুই যত ফুল দিস না কেনে (ওগো বধু সুন্দরী, ১৯৮০); জানো নাকি তুমি কোথায় (বাপি), তোমরা পয়সা দিয়ে গানকে কেনো, আমি ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখা (প্রতিদান, ১৯৮৩); বলো তো কী করে ঘর বাঁধা যায় (বাপি), ওই নীল পাখিটাকে (বাপি), প্রেম কিসে হয় (দুজনে, ১৯৮৪);  এক যে ছিল দুয়োরানি (প্রতিকার, ১৯৮৭); যেখানেই থাকো, আমি মন দিয়েছি, তোমার মুখটা কী সুন্দর, চিরদিনই তুমি যে আমার (অমরসঙ্গী, ১৯৮৭); আকাশের চাঁদ, ফুল কেন লাল হয় (গুরুদক্ষিণা, ১৯৮৭)

সুরকারঅজয় দাস

আমারই এ কণ্ঠ ভরে (জীবন মরণ, ১৯৮৩); বৃষ্টি থামার শেষে (পারাবত প্রিয়া, ১৯৮৩); গুনগুন করে মন ভ্রমরা যে ওই (অমিত), এ মন আমার হারিয়ে যায় (অনুরোগের ছোঁয়া, ১৯৮৬)

সুরকারমৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়

ঝরঝর ঝরে (অমিত), এই মনটা যদি না থাকত, আমার কুয়াশা যে ওড়না (দুটি পাতা, ১৯৮৩)

সুরকারস্বপন চক্রবর্তী

আছে গৌর নিতাই, বন্ধ মনের দুয়ার দিয়েছি খুলে, এই রাতে একটুখানি কাছে, কে যেন আবীর, রামধনু রঙ নিয়ে (মোহনার দিকে, ১৯৮৪); কথা দিলাম (কিশোর) আজ আমি অচেনা যে (সুরের আকাশে, ১৯৮৮)

Tuesday, September 29, 2020

কাশীনাথ ভট্টাচার্য / হেমন্ত-সত্যজিৎ হয়ে আরডি, কিশোর-কণ্ঠে বদলেই গেল পৃথিবী!

বাংলা সিনেমার গানে বোম্বে, দ্বিতীয় পর্ব – কিশোর কুমার

পাঁচ ও ছয়ের দশকে বাংলা ছবির প্লেব্যাক সাম্রাজ্যে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের রাজত্ব। সঙ্গে মান্না দে, শ্যামল মিত্র ও মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। কিশোর কুমার তখন হিন্দি ছবিতে নিজের জমি শক্ত করতে আগ্রহী, যেখানে মহম্মদ রফি ছিলেন শীর্ষে, রাজ কাপুরের কারণে মুকেশও এগিয়ে খানিকটা। সাতের দশকের শুরুর দিক থেকে রাহুল দেব বর্মন তৈরি করে ফেললেন নিজের জায়গা, রাজেশ খান্নাও হয়ে উঠলেন বোম্বের সুপারস্টার। বলা হয়, রাজেশের সেই উত্থানে সমান অবদান কিশোরেরও আরাধনা পায়ের নিচে জমি দিয়েছিল রাজেশকে আর কিশোরকে দিয়েছিল বোম্বেতে কাঙ্ক্ষিত জায়গাটা। সঙ্গে রাহুলের বন্ধুত্ব এবং এই ত্রয়ীর ছক্কা হাঁকানো সাতের দশকের শুরু থেকেই।

বাংলা সিনেমায় কিশোরের প্রথম গান নিয়ে অবশ্য সংশয়ের অবকাশ নেই তাঁরই প্রযোজিতলুকোচুরিছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুর গায়ক ও নায়ক হিসাবে কিশোর সেখানে চারটি গান গেয়েছিলেন। গীতা দত্ত ও রুমা গুহঠাকুরতার সঙ্গে দুটি ডুয়েট এবং ‘এক পলকের একটু দেখা’ ও ‘শিং নেই তবু নাম তার সিংহ’ অভিষেকেই চার গোল!

ছয়ের দশকে যেহেতু ব্যস্ততা বোম্বেতেই, বাংলায় তেমন জনপ্রিয় গান পাওয়া যায়নি কিশোরের। ব্যতিক্রম হিসাবে থেকে গিয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের চারুলতা, যেখানে কিশোরের খোলা গলা কাজে লাগিয়েছিলেন পরিচালক। প্রায় বছর কুড়ি পর, ঘরে বাইরে ছবিতেও ব্যবহার করবেন তাঁকেই। আবার, গুপি-বাঘার গানের ক্ষেত্রেও, সন্দীপ রায় জানিয়েছেন, কিশোরকেই পছন্দ ছিল সত্যজিতের। কিন্তু, সেই সময় নানা কারণে খুব ব্যস্ত কিশোরের পক্ষে সময় বের করা সম্ভব হচ্ছিল না। তখন সত্যজিৎ বেছে নিয়েছিলেন অনুপ ঘোষালকে এবং পরেরটুকু, ইতিহাস!

রাহুল-উত্তম-কিশোর

সাতের দশকের শুরুতে রাজকুমারী ছবিতে উত্তমকুমারের জন্য কিশোর কুমারের কণ্ঠ ব্যবহার করেছিলেন আরডি। সিনেমাটা চলেনি যেমন, সেই সময় গানও চলেনি। কিন্তু, উত্তমের লিপে কিশোর সেই প্রথম। পরে কিশোরই স্বীকার করেছিলেন, সেই সময় বাঙালির মহানায়কের কণ্ঠমাধুর্য ঠিকঠাক না বুঝেই গেয়ে ফেলেছিলেন বলেই হয়ত ঘটেছিল তেমন। শক্তি সামন্ত তারপর করেছিলেন দুটি দ্বিভাষিক ছবি – অমানুষ ও আনন্দ আশ্রম। দুটিতেই নায়কের চরিত্রে উত্তম কুমার। সুরকার হিসাবে ছিলেন শ্যামল মিত্র। উত্তমের লিপে হেমন্ত ছাড়িয়ে তখন মান্নার যুগ। কিন্তু শক্তি সামন্তই নাকি শ্যামল মিত্রকে বলেছিলেন, কিশোরকে ব্যবহার করতে। প্রাথমিক একটু অস্বস্তি ছিল শ্যামলের। পরে মেনে নেন পরিচালকের কথা। রোমান্টিক নায়ক হিসাবে রাজেশ খান্নার সঙ্গে যাঁর গলা তখন জুড়ে গিয়েছে ভূভারতে, বাঙালির সেরা অভিনেতার পর্দায় রোমান্টিক ভাবমূর্তির সঙ্গে  কিশোরের জুটি কেনই বা জমবে না, এই ভাবনা থেকেই নাকি এসেছিলেন কিশোর।

অমানুষের হিন্দি ভার্সানে ‘দিল অ্যায়সা কিসিনে মেরা তোড়া’ ফিল্মফেয়ার পেয়েছিল। আর বাংলায় ‘কী আশায় বাঁধি খেলাঘর’ এখনও ব্লকবাস্টার। আশা ভোঁসলের সঙ্গে উত্তম-শর্মিলা মিষ্টি প্রেমের ‘যদি হই চোরকাঁটা ওই শাড়ির ভাঁজে’ একই রকম জনপ্রিয়। দু-বছর পর আনন্দ আশ্রমে ওই একই জুটির ছবিতে শক্তির পরিচালনায় আবারও শ্যামল সুরকার এবং এবার তিনটি গান। আশার সঙ্গে ‘আমার স্বপ্ন তুমি ওগো চিরদিনের সাথী’, আর কিশোরের সোলো দুটি – ‘পৃথিবী বদলে গেছে’ ও ‘আশা ছিল ভালবাসা ছিল’। উত্তম কুমারের লিপেও প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিলেন কিশোর।

পরে, ১৯৮০ সালে বাপি লাহিড়ি যখন সুযোগ পেলেন ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ ছবিতে সুরকার হিসাবে, কিশোরকে দিয়েই চারটি গান করালেন। ‘এই তো জীবন’, ‘আমি একজন শান্তশিষ্ট পত্নীনিষ্ঠ ভদ্রলোক’, ‘নারী চরিত্র বেজায় জটিল’ এবংশুধু তুমি নয় অবলাকান্ত’মনে রাখা প্রয়োজন, রাহুল দেব বর্মনই কিন্তু ‘রাজকুমারী’ ছবিতে, সেই ১৯৭০ সালে উত্তমের লিপে এনেছিলেন কিশোরকে।

সাতের দশকের শেষে সলিল চৌধুরি দুটি ছবিতে কিশোরকে কাজে লাগিয়েছিলেন দুর্দান্তভাবে। কবিতা-য় কমল হাসান এবং অন্তর্ঘাত ছবিতে মিঠুন চক্রবর্তীর লিপে দিয়ে গিয়েছিলেন দুটি অমর সৃষ্টি – যথাক্রমে ‘শুনো শুনো গো সবে’ এবং ‘মনে পড়ে সেই সব দিন’। গোলমাল ছবিতে অমল পালেকারের লিপে ‘আনেওয়ালা পল ।আনেওয়ালা হ্যায়’ যেমন অমর, বীরেশ্বর সরকার ‘মাদার’ ছবিতে অমলের জন্য ব্যবহার করলেন সেই কিশোরকেই‘আমার নাম অ্যান্টনি’ ওকী দারুণ দেখতে’, সোলো। আজও জনপ্রিয়। আশার সঙ্গে দুষ্টুমিষ্টি ‘এক যে ছিল রাজপুত্তুর’, পর্দায় অমল ও শর্মিলার মিষ্টি প্রেমপরে, ১৯৮৪ সালে বেরনো ‘প্রার্থনা’ ছবিতে বাসুদেব চক্রবর্তীও হাঁটলেন একই রাস্তায়। ‘চেয়েছি যারে আমি’ অমলের লিপে গাইয়ে নিলেন, সেই কিশোরকে দিয়েই।

আমারই কণ্ঠ ভরে

আটের দশকে অবশ্য কিশোর ছাড়া আর কেউ নেই-ই প্রায়, বাংলা ছবিতে নায়কদের প্লেব্যাক-এ। এমনিতেই আটের দশক খুব একটা ভাল নয় বাংলা সিনেমার গানের ক্ষেত্রে। মনে রাখার মতো যতগুলো প্রচেষ্টা, সিংহভাগ কিশোরের। সুখেন দাসের ছবি, অজয় দাসের সুর এবং অনবদ্য কিশোর কুমার। একা রাজত্ব করলেন। আরডি এবং বাপি লাহিড়ি তো ছিলেনই, অজয় দাসের সুরে প্রায় কুড়িটি গান গেয়েছিলেন কিশোর সেই সময় এবং প্রতিটিই প্রবল জনপ্রিয়।

সুখেন দাসের ছবিতে প্রথমবার কিশোরকে গাওয়ানো নিয়ে এক মজার গল্প আছে। সুখেন-অজয় দুজনেই মুম্বইতে, সঙ্গে আরও কয়েকজন। প্রতিশোধ ছবিতে চাই কিশোরকে। বাড়ির দরোয়ানকে হাত করে কিশোরের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে চেষ্টা করেছিলেন সুখেন-অজয়। সে-কারণে দরোয়ানের খানাপিনা ইত্যাদির খরচও সরবরাহ করতে হচ্ছিল। কিন্তু কিছুতেই দেখা পাওয়া যাচ্ছিল না। ওদিকে, মুম্বইতে দিনের পর দিন থাকতে গিয়ে পকেটের হাল খারাপ থেকে খারাপতর। শেষে একদিন সুখেন নিজেই কিশোরের বাড়ি গিয়ে চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছিলেন, সরাসরি কিশোরের সঙ্গে কথা বলে, জবাবদিহিও চেয়ে। সব শুনে কিশোর থ। পরে সব ঠিকঠাক, জানা গিয়েছিল কিশোরের বাড়ির দরোয়ান জানাননি কিছু মালিককে। আর কখনও কোনও অসুবিধা হয়নি, অজয়ের সুরে কিশোরের গানও বেরলেই সুপারহিট। ‘কত কী রয়েছে লেখা’ বই-এ সুমন গুপ্ত লিখেছিলেন সেই গল্প।

বাপি লাহিড়িও তাঁর ‘কিশোরমামা’-কে ভরিয়ে দিয়েছিলেন অমরসঙ্গী ও গুরুদক্ষিণায়। রাহুলের সহকারীরা, স্বপন চক্রবর্তী, বাসুদেব চক্রবর্তীরাও যে যেভাবে পারলেন, রাহুলের সঙ্গে কিশোরের সম্পর্কের সূতো ধরে পেয়ে গেলেন চিরন্তন হিট কিছু গান। স্বপন-জগমোহন জুটির সুরে রনজিৎ মল্লিক এবং তনুজার ‘লালকুঠি’ ছবিতে ড্যানির লিপে ‘কারও কেউ নইকো আমি’-ও সিনেমা হিট হওয়ার অন্যতম কারণ যেমন, এখনও বাংলায় কিশোরকণ্ঠীরা জলসায় এই গানের অনুরোধ পেয়ে থাকেন, শোনানও।

অকালমৃত্যুর আগে পর্যন্ত কিশোর কুমারই ছিলেন বাংলা ছবির গানে মুকুটহীন সম্রাট, ঠিক যেমন ছিলেন হিন্দিতেও। বাংলা ছবিতে তাঁর মোট গান লতার (১৩৮) তুলনায় একটু বেশি – ১৪৯

প্রকাশিত শেষ গান, মৃত্যুর পর। গৌতম বসুর সুরে, হীরক জয়ন্তী ছবিতে, ১৯৯০ সালে। প্রতীকী - ‘বহু দূর থেকে এ কথা, দিতে এলাম উপহার’!

 

কিশোর কুমার (বাংলা ছায়াছবির জনপ্রিয় কিছু গান)

সুরকারহেমন্ত মুখোপাধ্যায়

শুধু একটুখানি চাওয়া (গীতা), এই তো হেথায় (রুমা), এক পলকে একটু দেখা, শিং নেই তবু নাম তার সিংহ (লুকোচুরি, ১৯৫৮); ওগো নিরুপমা (অনিন্দিতা, ১৯৭২); কী করে বোঝাই তোদের (প্রক্সি, ১৯৭৭)

পরিচালকসত্যজিৎ রায়

আমি চিনি গো চিনি (রবীন্দ্রসঙ্গীত, চারুলতা, ১৯৬৪); বিধির বাঁধন কাটবে তুমি, চল রে চল সবে ভারত সন্তান, বুঝতে নারি নারী কী চায় (ঘরে বাইরে, ১৯৮৪)

সুরকাররাহুল দেববর্মন

এ কী হল, কী বলিতে এলে (রাজকুমারী, ১৯৭০); আমার স্বপ্ন যে (লতা), ফুলকলি রে ফুলকলি (আশা), কালিরামের ঢোল (অনুসন্ধান, ১৯৮০); আধো আলো ছায়াতে (আশা) (কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী, ১৯৮১); আরও কাছাকাছি (আশা), জানা অজানা (আশা, আরডি), একটানেতে যেমন তেমন (ত্রয়ী, ১৯৮২); পথ হোক বন্ধুর (শৈলেন্দ্র, শক্তি), চুরি ছাড়া কাজ নেই (লতা), নতুন সে তো নতুনই (আশা), এমন মজার শহর (তিনমূর্তি, ১৯৮৪); ছেড় না ছেড় না হাত (সাবিনা), দেখলে কেমন তুমি খেল, রুই কাতলা ইলিশ তো নয় (অন্যায় অবিচার, ১৯৮৫)

সুরকারশ্যামল মিত্র

যদি হই চোরকাঁটা (আশা), কী আশায় বাঁধি খেলাঘর (অমানুষ, ১৯৭৫); আমার স্বপ্ন তুমি (আশা), পৃথিবী বদলে গেছে, আশা ছিল ভালবাসা ছিল (আনন্দ আশ্রম, ১৯৭৭); মনে হয় স্বর্গে আছি (বন্দি, ১৯৭৮); কোনও কাজ নয় আজ (আশা), একই সাথে হাত ধরে (আশা), কিছু কথা ছিল চোখে (কলঙ্কিনী, ১৯৮১)

সুরকারশচীন দেব বর্মন

আজ হৃদয়ে ভালবেসে (লতা), এত কাছে দুজনে, মোর স্বপ্নেরই সাথী (আরাধনা, ১৯৭৬)

সুরকারসলিল চৌধুরি

শুনো শুনো গো সবে (কবিতা, ১৯৭৭); ও আমার সজনী গো (লতা), মনে পড়ে সেই সব দিন (অন্তর্ঘাত ১৯৮০, পরে, সিনেমার নাম পাল্টেস্বর্ণতৃষা’)

সুরকারস্বপন-জগমোহন

ঢলে যেতে যেতে (আশা), কারও কেউ নইকো আমি (লালকুঠি, ১৯৭৮); পারি না সইতে, চোখেতে শাওন গায় গুনগুন (জ্যোতি, ১৯৮৭)

সুরকারবীরেশ্বর সরকার

এক যে ছিল রাজপুত্তুর (আশা), আমার নাম অ্যান্টনি, কী দারুণ দেখতে (মাদার, ১৯৭৯)

সুরকারবাপি লাহিড়ি

এই তো জীবন, আমি একজন শান্তশিষ্ট, নারী চরিত্র বেজায় জটিল, শুধু তুমি নয় অবলাকান্ত (ওগো বধূ সুন্দরী, ১৯৮০); আজ এই দিনটাকে (অন্তরালে, ১৯৮২); হো রে রে রে রে (প্রতিদান, ১৯৮৩); হে জোরে চলো (দুজনে, ১৯৮৪); চিরদিনই তুমি যে আমার (অমরসঙ্গী, ১৯৮৭); তোমরা যতই আঘাত করো, কোথা আছ গুরুদেব, এ আমার গুরুদক্ষিণা (গুরুদক্ষিণা, ১৯৮৭)

সুরকারঅজয় দাস

হয়ত আমাকে কারও মনে নেই, আজ মিলনতিথির পূর্ণিমা চাঁদ (প্রতিশোধ, ১৯৮১); এ তো কান্না এ তো নয় গান (সংকল্প, ১৯৮২); অনেক জমানো ব্যথা বেদনা (পারাবত প্রিয়া, ১৯৮৩); কী উপহার সাজিয়ে দেব, ওপারে থাকব আমি, আমারই এ কণ্ঠ ভরে (জীবন মরণ, ১৯৮৩); আজ শুভদিনে যদি (আরতি) (দাদামণি, ১৯৮৩); আমি যে কে তোমার (অনুরাগের ছোঁয়া, ১৯৮৬); আর তো নয় বেশিদিন, সুখেও কেঁদে ওঠে মন (মিলনতিথি, ১৯৮৬); দুজনাতে লেখা গান (অভিমান, ১৯৮৬); ফোটে যে রক্ত গোলাপ (লালমহল, ১৯৮৬); তুমি মা আমাকে, এই তো জীবন (অমর কন্টক, ১৯৮৭)

সুরকাররবীন্দ্র জৈন

ও মা পতিত পাবনী গঙ্গে (হরিশ্চন্দ্র শৈব্যা, ১৯৮৪)

সুরকারস্বপন চক্রবর্তী

নাই নাই এ আঁধার থেকে (মোহনার দিকে, ১৯৮৪); প্রেমের খেলা কে বুঝিতে পারে, কথা দিলাম (সুরের আকাশে, ১৯৮৮)

সুরকারবাসুদেব চক্রবর্তী

চেয়েছি যারে আমি (প্রার্থনা, ১৯৮৪)

সুরকারমৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়

জানি যেখানেই থাকো, তোমার বাড়ির সামনে দিয়ে (তুমি কত সুন্দর, ১৯৮৮)

সুরকারকানু ভট্টাচার্য

ওরে মন পাগল, আমারও তো গান ছিল (দোলন চাঁপা, ১৯৮৯)

সুরকারমানস মুখার্জি

এই জীবনের পথ সোজা নয় জেনো (বান্ধবী, ১৯৮৯)

সুরকারগৌতম বসু

বহু দূর থেকে এ কথা (হীরক জয়ন্তী, ১৯৯০)

Monday, September 28, 2020

কাশীনাথ ভট্টাচার্য / শ্যামল মিত্র যখন ওপি নাইয়ার!

বাংলা সিনেমার গানে বোম্বে,  প্রথম পর্ব – লতা  মঙ্গেশকার

লতা মঙ্গেশকারকে দিয়ে একটিও বাংলা সিনেমার গান গাওয়াননি! ৯১তম জন্মদিনে ফিরে-দেখা, শুধুই বাংলা ছায়াছবির গানে

বাংলা ছবিতে লতা মঙ্গেশকরের প্রথম গান ১৯৫২ সালে ‘অমর ভূপালি’ ছবিতেবউঠাকুরানির হাট’ (১৯৫৩) ছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁকে দিয়ে প্রথমবার বাংলা ছবিতে গাইয়েছিলেন, বলা হয়। কারণ, সেই ছবির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন দ্বিজেন চৌধুরি। কিন্তু লতাকে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে রাজি করানো থেকে সবই হেমন্ত। ‘হৃদয় আমার নাচে রে আজিকেদিয়েই বাংলা ছবিতে লতারডেবিউ’, প্রচলিত কথা সেই ছবিতেই আরও একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছিলেন লতাশাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা কিন্তু, তার এক বছর আগেই মরাঠি এবং বাংলায় দ্বিভাষিক ছবিঅমর ভূপালি’, মহারাষ্ট্রে যা বেরিয়েছিল ১৯৫১ সালে এবং ১৯৫২ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে নমিনেশনও পেয়েছিল ভি শান্তারামের পরিচালনা, সুর করেছিলেন বসন্ত দেশাই সেই ছবিটি বাংলাতেও হয়েছিল বসন্ত দেশাই-ই সুর করেছিলেন বাংলায় কথা লিখেছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। শুধু বাংলাই নয়, দুটি গানে ব্যবহৃত হয়েছিল ‘ব্রজভাষা’, জানালেন লতা মঙ্গেশকারকে নিয়ে কাজ করেছেন যিনি, সেই স্নেহাশিস চট্টোপাধ্যায় আর লতা মঙ্গেশকারের সঙ্গে সেই প্রথম ছবিতেই দ্বৈত গান ছিল মান্না দে-, ‘ঘনশ্যাম সুন্দর শ্রীধর সেই ছবির বাকি পাঁচটি গানও তুলে ধরেছেন স্নেহাশিস, তাঁরলতা গীতকোষ, প্রথম পর্ব’-, যে-বইতে আলোচ্য সঙ্গীত সম্রাজ্ঞীর শুধুই বাংলা গান সেই গানগুলি – তুয়া পিরীতে দুখ সদা দিও না মোরে, কানহো দূর দেশে যাও বঁধুয়া, সুখে মাতে চিত, লটপট লটপট, মরি মরি ওরে সুখের কথা, ইউটিউবে প্রতিটি গান শুনে নেওয়ার সুযোগ এখন আপনার হাতের মোবাইলেই!

তোমাদের আসরে আজ

তিনি মরাঠি। বাংলা উচ্চারণে আজকের তো বটেই, তখনও অনেককেই পেছনে ফেলে দিতেন। হিন্দি ছবিতে শুরু করেছিলেন যখন, একবার ট্রেনে ইউসুফ খাঁ ওরফে দিলীপ কুমারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। লতার সঙ্গী ছিলেন সুরকার অনিল বিশ্বাস। দিলীপ কুমারের সঙ্গে লতার পরিচয় করিয়ে অনিল বিশ্বাস জানিয়েছিলেন, দুর্দান্ত গায়িকাইউসুফ জানতে চেয়েছিলেন পরিচয়। যখন শুনেছিলেন মরাঠি, দিলীপ পরিষ্কার জানিয়েছিলেন, মরাঠিদের উর্দু উচ্চারণে ‘দাল-ভাত’-এর গন্ধ। ‘নিয়োগী বুকস’ প্রকাশিত, নাসরিন মুন্নি কবীর-এর ‘লতা ইন হার ওন ভয়েস’ বইতে লতা জানিয়েছেন, ‘খুব খারাপ লেগেছিল শুনে।’ ওভাবে মুখের ওপর কেউ যে তাঁর উচ্চারণ নিয়ে কথা বলবে, তখন ভাবতেই পারেননি। ইউসুফও তখন লোকাল ট্রেনেই চলাফেরা করতেন। আজকের দিলীপ কুমার নন, সেই ১৯৪৮-৪৯ সালে। লতা তখনই ঠিক করে নিয়েছিলেন, কী করতে হবে। অনিল বিশ্বাস এবং নৌশাদের সঙ্গে কাজ করতেন মহম্মদ শফি। সেই শফি তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন এক মৌলানার কাছে, মেহবুব। উর্দু শিখতে শুরু করেছিলেন যাতে গানের কথায় উর্দু শব্দ থাকলে উচ্চারণে সহজে ভুল খুঁজে না-পাওয়া যায়।

বাংলার ক্ষেত্রেও একই মানসিকতা কাজ করেছিল বলেই তাঁর উচ্চারণ প্রায়-নিখুঁত। আর তখনকার বোম্বেতে তো বাঙালিদের সঙ্গেই তাঁর ওঠাবসা তখন। অনিল বিশ্বাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরি,  মান্না দে। রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসাবে হেমন্ত নিজে জানতেন, বাঙালি ভুল উচ্চারণে রবীন্দ্রসঙ্গীত কিছুতেই নেবে না। কতটা আত্মবিশ্বাসী হলে রবীন্দ্রনাথের গান গাইয়েই বাংলা ছবিতে লতার ইনিংস শুরু করানো যায় - হেমন্তর ঝুঁকিটা ভাবুন।

হিন্দি ছবিতে আর বাংলা বেসিক গানে সলিল চৌধুরি যেমন দুহাত ভরে দিয়ে গিয়েছিলেন লতাকে, বাংলা ছবিতে সেই ভূমিকায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। গানের সংখ্যাতেই প্রমাণ। সলিলের সুরে ৩৫টি আধুনিক গান করেছিলেন লতা, হেমন্তর সুরে ৩৪টি গান বাংলা ছবিতে! গায়ক হেমন্তকে যতটা মাথায় তুলেছে বাঙালি, সুরকার হেমন্ত তার চেয়েও বেশি কৃতিত্বের দাবিদার নন? কবীর সুমন তাঁর গানে যেমন বলেছিলেন ‘সহজ সুরের শয়তানি’, সেই সহজিয়া সুরের কারণেই হয়ত বাঙালি আবার একটু সরে-সরে যায়। জটিলতা, গিটকিরি বা হরকত-নির্ভরতার প্রতি একটু বেশি ভালবাসা দেখিয়ে সঙ্গীতে অতি-শিক্ষিত হওয়ার ভান করে, অন্য সব ক্ষেত্রের মতোইতবে সে অন্য প্রসঙ্গ।

যেহেতু সঙ্গীতকার হিসেবেও হেমন্ত ‘সহজে গুনগুন করা যাবে’ এই রাস্তা থেকে সরে আসতে রাজি ছিলেন না, তাঁর পরিচালিত সঙ্গীত নিয়েও আলোচনা তুলনায় কম হয়, এই বাংলাতেই। সেই কারণে অনেকাংশে অনালোচিত থেকে যায় হেমন্তর সুরে লতার বাংলা ছায়াছবির গানও। কিন্তু, তালিকা করে পাশাপাশি রাখলে মনপাখির ডাকাডাকি গোপন রাখা কঠিন শুধু নয়, অসম্ভব। চঞ্চল মন আনমনা হবেই তখন! এমনকি, বাঙালির মহানায়িকা সুচিত্রা সেনকে ঘিরে লতা মঙ্গেশকারের গানও প্রথম এনে দিয়েছিলেন সেই হেমন্তই। ১৯৫৯ সালে, দীপ জ্বেলে যাই ছবিতে, ‘আর যেন নেই কোনও ভাবনা’। সুরের সহজ চলনে যে গান আজও আমবাঙালির মনজুড়ে।

হেমন্তের পর রাহুলের সুরে সবচেয়ে বেশি গান গেয়েছেন লতা, বাংলা ছবিতে। মোট ১৮টি। আর কোনও সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গে লতার গান দু-অঙ্কে পৌঁছয়নি, বাংলা ছবিতে। ৯টি করে গান শচীন দেববর্মন ও বাপি লাহিড়ির সুরে। বীরেশ্বর সরকারের সুরে ‘সোনার খাঁচা’ এবং ’মাদার’, দুটি ছবির গানেই যেন জ্বলেছিল হাজার তারার আলো। আর, শুরুতে বসন্ত দেশাইয়ের পর মান্না দে-র সঙ্গে লতার বাংলায় দুটি সুপারহিট দ্বৈত গানের একটির সুর বীরেশ্বরের (এই বৃষ্টিতে) অন্যটির সুধীন দাশগুপ্ত (কে প্রথম কাছে এসেছি)।

এ-ও ঠিক, ছয় ও সাতের দশকে যত বেশি গান গেয়েছিলেন, আট ও নয়ের দশকে, হিন্দির মতোই আস্তে আস্তে গানের ব্যাটনটা চলে গিয়েছিল বোন আশা ভোঁসলের হাতে। আটের দশকে তিনটি ছবির নাম মনে থাকবে বিশেষ করে – অনুসন্ধান, প্রতিদান ও অনুরোগের ছোঁয়া।

মোট ৩২ জন সুরকারের গান বাংলা ছবিতে গেয়েছেন লতা মঙ্গেশকার। নচিকেতা ঘোষ, ভুপেন হাজারিকা, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়, অজয় দাস – সেই তালিকাও ঈর্ষণীয়।

কিন্তু, হিন্দিতে যেমন ওপি নাইয়ার, বাংলায় তেমনই শ্যামল মিত্র। নাইয়ার সাহেবকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়, যা তিনি কখনও করেননি সেই কারণেই। অর্থাৎ, তাঁর সুরে নেই লতার কোনও গান। বাংলা সিনেমায় তেমনই সুরকার শ্যামল মিত্র কখনও গাওয়াননি লতাকে দিয়ে। নাইয়ারের মতোই তাঁরও তুলনায় বেশি পছন্দ ছিলেন আশা, অন্তত তাঁর সুরারোপিত গানের শিল্পী তালিকা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। কেন এমন, কারণ জানাননি শ্যামল

লতা মঙ্গেশকার (বাংলা ছায়াছবির জনপ্রিয় কিছু গান)

সুরকার - সলিল চৌধুরি

জাগো মোহন প্রীতম (একদিন রাত্রে, ১৯৫৬); হায় হায় প্রাণ যায় (মর্জিনা আবদাল্লা, ১৯৭২); বুঝবে না কেউ বুঝবে না, হঠাৎ ভীষণ ভাল লাগছে (কবিতা, ১৯৭৭); ও আমার সজনী গো (কিশোর) (অন্তর্ঘাত ১৯৮০, পরে, সিনেমার নাম পাল্টেস্বর্ণতৃষা’)

সুরকার - নচিকেতা ঘোষ

রিনিকি ঝিনিকি ছন্দে, পূর্ণিমা নয় এ যেন রাহুর গ্রাস (অসমাপ্ত, ১৯৫৬)

সুরকারহেমন্ত মুখোপাধ্যায়

আর যেন নেই কোনও ভাবনা (দীপ জ্বেলে যাই, ১৯৫৯); কে যেন গো ডেকেছে আমায় (হেমন্ত), আষাঢ় শ্রাবণ, নিঝুম সন্ধ্যায় (মনিহার, ১৯৬৬); চঞ্চল ময়ূরী এ রাত, চঞ্চল মন আনমনা হয় (হেমন্ত), যাবার বেলায় (অদ্বিতীয়া, ১৯৬৮); যদিও রজনী (বাঘিনী, ১৯৬৮); চলে যেতে যেতে দিন (মন নিয়ে, ১৯৬৯); কে জেগে আছ (কুহেলি, ১৯৭১); ওরে মন পাখি (অনিন্দিতা, ১৯৭২); ওই গাছের পাতায় (রাগ অনুরাগ, ১৯৭৫); তোমাদের আসরে আজ (প্রক্সি, ১৯৭৭); এসো এসো এসো প্রিয় (সানাই, ১৯৭৭);

সুরকার – শৈলেন মুখোপাধ্যায়

আমার কথা শিশির ভেজা (দোলনা, ১৯৬৫)

সুরকার – সুধীন দাশগুপ্ত

কে প্রথম কাছে এসেছি (মান্না), আজ মন চেয়েছে (শঙ্খবেলা, ১৯৬৬)

সুরকার – বীরেশ্বর সরকার

যা যা যা ভুলে যা, বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি (সোনার খাঁচা, ১৯৭৩); এই বৃষ্টিতে ভিজে মাটি (মান্না) হাজার তারার আলোয় ভরা, হতাম যদি তোতাপাখি (মাদার, ১৯৭৯)

সুরকাররাহুল দেববর্মন

আমার স্বপ্ন যে (কিশোর), ওঠো ওঠো সূর্যাই রে, হায় রে পোড়াবাঁশি ঘরেতে (অনুসন্ধান, ১৯৮০); না না কাছে এসো না (কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী, ১৯৮১); চুরি ছাড়া কাজ নেই (কিশোর) (তিনমূর্তি, ১৯৮৪)

সুরকারবাপি লাহিড়ি

মঙ্গল দীপ জ্বেলে (প্রতিদান, ১৯৮৩); বলছি তোমার কানে কানে (আমার তুমি, ১৯৮৯); সব লাল পাথরই তো (মন্দিরা, ১৯৯০)

সুরকার – অজয় দাস

আমি যে কে তোমার (অনুরাগের ছোঁয়া, ১৯৮৬);

সুরকার – কানু ভট্টাচার্য

আমারও তো সাধ ছিল (দোলনচাঁপা, ১৯৮৭)