কিশোরফিল্মের চপলতা আর কিশোরগানের পাগলপারা সুরদরিয়ায় অবগাহন, দুটি বই পড়তে গিয়ে কৈশোরের কিশোরপ্রেমে ফের মাতোয়ারা
কাশীনাথ ভট্টাচার্য
‘মাত্র একটাই বই পড়ার চেষ্টা করেছিলাম। দিয়েগোর আত্মজীবনী ইয়ো সোই। শেষ করতে পারিনি!’
লিওনেল মেসির স্বীকারোক্তি। বই পড়তে তাঁর মোটেও ভাল্লাগে না। তাই আদর্শ মারাদোনার আত্মজীবনী এবং মাতৃভাষা স্প্যানিশে লেখা হলেও, নিজের ওপর জোর খাটাননি। সমস্যা এল বিদ্বৎসমাজ থেকে। কী অশিক্ষিত রে বাবা! লন্ডন টাইমস না ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান, কোন্ কাগজে পড়েছিলাম এখন আর মনে নেই, নিবন্ধকারের জ্বালাময়ী লেখায় জুড়ল অবশ্যম্ভাবী — এত টাকা, কিন্তু শিক্ষার বহরটা দ্যাখো। জীবনে হয়ত আট–দশহাজারি বই পড়ুয়ার সে কী শিক্ষার গুমোর!
বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ভাষায় হাজার–হাজার বইয়ের বিষয় হয়ে উঠবেন যিনি, লক্ষ–লক্ষ শব্দ লেখা হবে যাঁকে নিয়ে, সেই মেসিকে বই পড়তেই হবে, এই ‘খাপ’ কেন যে বসে বিশ্বজুড়ে!
কিশোরকুমারকে নিয়েও হাঁটা অনেকটা একই পথে। ‘প্রথাগত সঙ্গীতের তালিম ছিল না’, তাঁকে নিয়ে লিখতে গেলেই অবশ্যম্ভাবী উল্লেখ। তাই নমক হালাল–এ ‘পগ ঘুঙরু বাঁধ মীরা নাচি থি’ গানের সরগম গাওয়ানো হয় পণ্ডিত সত্যনারায়ণ মিশ্রকে দিয়ে, যিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কুশলী শিল্পী। বোঝানোর চেষ্টা, ‘ওটা কিশোরের কম্মো নয়’!
অথচ, ‘তুমি ছাড়া আর কোনও কিছু ভাল লাগে না আমার’ এবং ‘ভালবাসার আগুন জ্বেলে কেন চলে যায়’ মুকুল দত্তের কথা ও লতা মঙ্গেশকারের কণ্ঠে যে গানদুটি শুনে আমাদের বড়–হওয়া, সুরে সাজিয়েছিলেন কিশোরকুমার। প্রথাগত শিক্ষা না–থাকা সত্ত্বেও! হিন্দি ছায়াছবির সুরের জগতে খুঁজলে প্রথমেই মনে পড়বে ‘আ চলকে তুঝে’। ছেলে অমিতের হাত ধরে শ্রোতাদেরও নিয়ে গিয়েছিলেন ‘এক অ্যায়সি গগনকে তলে, যঁহা গম ভি না হো, আঁসু ভি না হো, ব্যস প্যায়ার হি প্যায়ার পলে’। কবীর সুমন যেমন বলেছিলেন গানে, ‘জানি না কাঁদায় কেন সহজ সুরের শয়তানি’। কিশোরের এই ‘সহজ সুরের শয়তানি’ সহজাত, সঙ্গীতে ‘অশিক্ষিত’ হয়েও।
তাই প্রথাগত সঙ্গীতের তালিম ছিল না, ক্রমাগত এই উল্লেখের মাধ্যমে তাঁকে খাটো করে দেখাতে চাওয়ার কারণ বোঝা কঠিন। উল্টো প্রশ্নগুলো কেন করা হয় না, যেমন, সঙ্গীতের প্রথাগত শিক্ষা আছে যাঁদের, কেন তাঁরা হয়ে উঠতে পারলেন না কিশোরকুমার? কেন প্রয়াণের ৩৬ বছর পরও তাঁকে নিয়েই চর্চা? কেনই বা রেডিও–টিভি–রিয়েলিটি শো এখনও মজে কিশোরেই, ‘শিক্ষিত’ শিল্পীদের গানে ততটা নয়?
হার্পার কলিন্স থেকে প্রকাশিত অনিরুদ্ধ ভট্টাচার্য ও পার্থিব ধরের লেখা ৫৫৬ পাতার বই ‘কিশোরকুমার: দ্য আল্টিমেট বায়োগ্রাফি’ সরাসরি এই প্রসঙ্গে বিশেষ চর্চা না করেও অন্য রাস্তায় শুরু থেকেই। কিশোরকে নিয়ে লেখা বইয়ের প্রতিটি অধ্যায় সাজানো হয়েছে রাগ–রাগিণীর নামে; জোগিয়ায় শুরু, কেদারে শেষ। বই জানিয়েছে কিংবদন্তি সুরকার নৌশাদের উষ্মার কথাও। ‘আজকালকার গান? ওই তো আরডি (বর্মন) সুর দেয় আর কিশোর গায়’ (পৃষ্ঠা ৩৬৫)। বাঙালি হলে ‘পাতে দেওয়ার যোগ্য নয়’ জুড়ে দিতেন, নিশ্চিত! বিদ্রুপের সঙ্গেই চূড়ান্ত হতাশাও সঙ্গী তখন নৌশাদের। তাঁকে বাদ দিয়ে আরডি–র হাতে সুরের দায়িত্ব আর তাঁর প্রিয় মহম্মদ রফিকে ছেড়ে কিশোরকে দিয়ে গাওয়ানোর ‘ট্রেন্ড’ — একেবারেই মানতে না পেরে এই ‘শিক্ষিত’ বিষোদ্গার। মুশকিল, শিক্ষায় বিদ্রুপ–বিষোদ্গার সর্বদা পরিত্যজ্য, পরিহার্য।
১৯৮৭ সালের ১৫ নভেম্বর মনোরমায় লক্ষ্মীরাম চৌধুরির লেখা তুলে এনেছেন দুই লেখক, যেখানে নৌশাদের ওই বক্তব্যের পরই বলা ছিল, ‘‘ভেতরে তখন নৌশাদের মেয়ে গাইছিলেন চন্দা ও চন্দা, কিশোর–লতার ডুয়েট, ১৯৭১ সালের ‘লাখো মে এক’ ছবিতে। সুর অবশ্যই আরডি–র।’’ এরপর কিছু বলা সত্যিই বাহুল্য!
‘পড়োশন’ সবারই মনে আছে। ‘এক চতুর নর’ গানে মেহবুবরূপী মান্না দের সঙ্গে কিশোরের গানের লড়াই প্রসঙ্গও বহুচর্চিত। মান্না নিজেই জানিয়েছিলেন, রেকর্ডিংয়ের সময় কিশোর হঠাৎ ‘ওয়ে টেরে, সিধে হো যা রে’ গেয়ে ফেলেছিলেন তাৎক্ষণিক বুদ্ধিমত্তায়, ফিল্মি সিচুয়েশনের সঙ্গতি রেখে, আপন মনের মাধুরী মিশায়ে। ওই লাইনটা লেখা ছিল না। হতচকিত মান্না তখন কাচের দেওয়ালের বাইরে দাঁড়ানো পঞ্চমের দিকে ইশারা করে জানতে চেয়েছিলেন, কী হচ্ছে এসব? পঞ্চমও হাত নেড়ে মান্নাকে ওই সব উপেক্ষা করে গান গেয়ে যেতে বলেছিলেন, ইশারায়ই। মান্না পরে বলবেন, ‘আমি তো গায়ক হিসাবে গাইছিলাম আর কিশোর গাইছিল সিনেমায় ওই পরিস্থিতির কথা ভেবে, ভেতর থেকে। সেই দিন থেকেই ওকে জিনিয়াস হিসাবে মেনে নিতে দ্বিধা করিনি।’ (পৃষ্ঠা ৩৪৪)
কিশোরের সাঙ্গীতিক মনন হয়ত তাঁর গায়কসত্তার প্রতি হয়ে–চলা প্রতিনিয়ত অসম্মানের সেই দিনগুলোর ভাবনায় এতটাই ব্যথিত ছিল যে, ঠিক সময়ে, সুযোগবুঝে গানের মাঝেই গুঁজে দিয়েছিলেন তাঁর অমোঘ বার্তা, তখনকার দিনের গানের প্রতি — ‘ওয়ে টেরে, সিধে হো যা রে’!
তাঁকে এই ‘সিধে’ গাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন একমেবাদ্বিতীয়ম শচীন দেববর্মন। আদেশ ছিল শচীনকত্তার, ‘সোজা গাইবি। দরদ দিয়ে, আবেগ দিয়ে। কথাগুলো জটিল করে তুলবি না।’ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন কিশোর, জীবনজুড়ে। একেবারে শুরুতে খেমচাঁদ প্রকাশের পর এসডি–ই ভরসা রেখেছিলেন তাঁর গলায়, গানে। যখন এমনকি দাদা অশোককুমারও গায়ক কিশোরের দক্ষতায় আস্থা রাখতে পারেননি, ভাইকে বলতেন গান ছেড়ে অভিনয়ে সময় দিতে, এসডি বুঝিয়েছিলেন দাদামণিকে, গান দিয়ে বাজিমাতের ক্ষমতা আছে কিশোরের। কথিত, ১৯৫৪ সালে বেরনো ‘মুনিমজী’ ছবির ঘটনা, সাহির লুধিয়ানভির কথায় ‘জীবন কে সফর মে রাহি’ গানের রেকর্ডিং–এর পর দাদাবর্মন চমকে দিয়েছিলেন সবাইকে। গান শেষ হওয়ার পরই শচীনকত্তার চিৎকার, ‘থাম্ থাম্, চুপ কর্ সবাই’। স্তব্ধ সবাই চকিতে। নিশ্চয়ই ভুল করেছে কেউ, আশঙ্কায় বিড়বিড়। দাদাবর্মন তারপর সোজা কিশোরের কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘কী গাইলি রে, দুর্দান্ত! তুই যদি এভাবেই গেয়ে যাস, আমার গান হিট হবেই।’ (পৃষ্ঠা ১৬৬)
রোল নম্বর ৪১৯৭
প্রীতীশ নন্দীর ভূমিকায় সমৃদ্ধ অনিরুদ্ধ–পার্থিবের ‘কিশোরকুমার: দ্য আল্টিমেট বায়োগ্রাফি’র পাতায় পাতায় তথ্যবিস্ফোরণ। বহু ‘মিথ’ ভেঙেছেন গবেষণায়। আর পাঠককে জুগিয়েছেন নতুন তথ্য যা তাঁদের সঙ্গী হবে অলস ভাবনাবিলাসে। অধুনা প্রচলিত রীতি, পুরনো কয়েকটা কাগজ থেকে কিছু লেখার অংশবিশেষ তুলে ধরলেই ‘গবেষণালব্ধ’ বিশেষণ জুড়ে–দেওয়া। অনিরুদ্ধ–পার্থিবের গবেষণার কিছু নমুনা তুলে ধরা যাক।
ধরা যাক, আপনি কিশোরকুমার সম্পর্কে অনেক কথা জানেন। স্বাভাবিক, আপনি কিশোর–ভক্ত। হয়ত, অভিনেতা কিশোরেরও। তাই অভিনীত কিছু ছবি এবং তার গান ইত্যাদি নিয়ে পড়েছেন, শুনেছেন, মনেও রেখেছেন। ভক্তের কাজ সেখানে শেষ, গবেষকের শুরু। অনিরুদ্ধ–পার্থিবের এই কিশোর–অণ্বেষণ পড়তে পড়তে মনে হওয়া স্বাভাবিক, আপনার মনে রয়ে–যাওয়া কিশোর তথ্যভাণ্ডার কৈশোর ছেড়ে যৌবরাজ্যেই পা ফেলেনি!
তথ্য খুঁজতে কত দূর যেতে পারেন জীবনীকার? যুগ্ম লেখকের অন্যতম পার্থিব মধুচন্দ্রিমায় গিয়েছিলেন খান্ডোয়া! নববধূর সঙ্গে পথচলা শুরু তাঁর জীবনের গুরুর আদি বাসস্থান ও শহরে। ‘অ্যাকাডেমিক’ জীবনী বেশি কেন, পড়িইনি প্রায়। তাই জানা নেই এমন সেখানে হয় কিনা। কিশোরকুমারের জীবনী জানাচ্ছে, ‘হিন্দি মাধ্যমে নাগপুর বোর্ডের সেকেন্ডারি পরীক্ষায় বসেছিল কিশোর, ১৯৪৬ সালে। ৮০০–য় ৩২৬, পাস করেছিল ৪০.৭৫ শতাংশ নম্বর পেয়ে। রোল নম্বর ৪১৯৭। তারপর স্কুল থেকে টিসি পেয়েছিল ২৪ জুন ১৯৪৬। সেই টিসি–র নম্বর ২৪৩। ওই স্কুলের খাতায় জন্মতারিখ ৪ অগাস্ট ১৯৩০।’ আর ১৮ জুলাই ১৯৩৯ সালে ভর্তি–হওয়া খান্ডোয়ার নিউ হাই স্কুল থেকে পাওয়া শেষ সেই শংসাপত্রে লেখা ছিল, ‘টিকা নিয়েছে, ব্যবহারও খুব ভাল।’ (পৃষ্ঠা ৫০)
তখন তাঁর বাবা কুঞ্জিলাল যে–নাম লিখেছিলেন, ইংরেজিতেই থাক, বোঝার সুবিধার কারণে — Keshore Kumar Gangoly। নামে ‘আই’ এর জায়গায় ‘ই’ এবং পদবিতে ‘ইউ’–এর জায়গায় ‘ও’। ‘কেশোর কুমার গাঙ্গোলি’। কিশোর আর কুমার আলাদা, একসঙ্গে নয়। ওই নামেই ইন্দোরের ক্রিশ্চিয়ান কলেজের খাতায় অ্যাডমিশন। যেমন নম্বর পেয়েছিলেন, ক্রিশ্চিয়ান কলেজে জায়গা পাওয়া সমস্যা হতে পারে জেনে বাবা চিঠিও লিখে দিয়েছিলেন প্রিন্সিপালকে, দুই ছেলে অনুপ ও কিশোরের জন্য। প্রথম চিঠিতে ছেলেরা কোন ক্লাসে ভর্তি হবে লিখতে ভুলে গিয়েছিলেন বলে পরে দ্বিতীয় চিঠিতে তা–ও জানান এবং কুড়ি টাকা জমা দেওয়ার কথাও। অর্থাৎ, বাবার কুড়ি টাকা কলেজ তহবিলে দানের কারণেই অনুপ–কিশোর ভর্তি হতে পেরেছিলেন কলেজে, ১৯৪৬ সালের ২১ জুন। ইন্টারমিডিয়েট আর্টস–এ ডিগ্রি নিতে, ক্লাসে কিশোর ছিলেন ১২৫তম ছাত্র। আর পড়তে চেয়েছিলেন হিন্দি, সিভিক্স ও ইকোনমিক্স। রেজাল্ট কেমন ছিল কিশোরের? লেখকরা জানিয়েছেন, ‘থার্ড ডিভিশনে পাস করে সেকেন্ড ইয়ারে।’ সঙ্গে ক্লাস–অ্যাটেন্ডেন্স রিপোর্টও! প্রথম বর্ষে ৪২৫–এর মধ্যে ৩২৫টি ক্লাসে উপস্থিত ছিলেন কিশোর। বাদ পড়ে যাওয়া ১০০ ক্লাসের বেশিরভাগ সময়ই তিনি বোম্বেতে, তারকা দাদামণির সঙ্গে। অনুসন্ধিৎসা কোথায় কোথায় নিয়ে গিয়েছিল লেখকদের! খুঁজে বের করার পরিশ্রম ও সময়ের কথা ছেড়েই দিন। এভাবে কোনও শিল্পীর স্কুল–কলেজের পুঙ্খানুপুঙ্খ রিপোর্ট, পড়েছি কি?
বইয়ের সেরা অংশ শুরুর এই দিনগুলোর কথাই। কিশোরের বন্ধু বা তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের মানুষের সঙ্গে কথা বলে তাঁর ছোটবেলার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ। কী করতেন, কীভাবে ছোটবেলা কাটিয়েছিলেন, কী খেতে ভালবাসতেন তখন, কীভাবে সেই ছোটবেলা বারেবারে ফিরে এসেছে তাঁর জীবনে — সব জানিয়েছেন অনিরুদ্ধ–পার্থিব। লিখেছেন, কলেজ জীবন থেকেই কিশোরের ‘প্লেব্যাক’ শুরু! বরাবরই ভাল গাইতেন, কিন্তু এতটাই লাজুক ছিলেন যে, মঞ্চে এসে গাইতে ভয় পেতেন। তাই কলেজের অনুষ্ঠানে থাকতেন পেছনে আর মঞ্চে কেউ একজন তাঁর গানে মুখ নাড়াতেন। অবিকল যেভাবে সিনেমার পর্দায় প্লেব্যাক হয়। ‘পড়োশন’ মনে পড়ছে না? আবার সেই ‘পড়োশন’–এর নায়ক সুনীল দত্তই ছিলেন নেপথ্যশিল্পীকে মঞ্চশিল্পী করে তোলার প্রধান কারিগর। সেনাবাহিনির ফাংশনে নিয়ে গিয়ে পর্দাঢাকা মঞ্চে কিশোর যখন চোখ বন্ধ করে গেয়ে চলেছেন, সুনীলের নির্দেশে পর্দা উঠে গিয়েছিল এবং দেখা গিয়েছিল কিশোরকুমারকে। তারপর তো মঞ্চশিল্পী কিশোরের কিসসা অগুনতি!
রয়েছে তথাকথিত ‘কৃপণতা’ ‘টাকা গোনা’ ‘পাগলামি’র গল্পও। ড্রয়িংরুমে নৌকো ভাসানো আর দেওয়ালের গাছে দাঁড়কাক সাজানোই হোক বা প্রযোজক পয়সা ঠিক সময়ে না–দেওয়ায় তাঁকে উত্যক্ত করার ঘটনাগুলো। লেখকদের সাধুবাদ প্রাপ্য, কারণ, যা যা ঘটেছে, যেমনভাবে, কাছাকাছি পৌঁছতে চেয়ে সেই ঘটনাগুলো তুলে ধরেছেন ‘জাজমেন্টাল’ না হয়ে। লেখকের কাজ সেই জার্নিটা সাবলীল ভাষায় ও সত্যি কথায় তুলে–ধরা। পড়ে যা মনে হবে পাঠকের, পূর্ণ স্বাধীনতা তাঁর ভেবে নেওয়ার, ঠিক কেমন ছিলেন কিশোরকুমার। ছবিটা পাঠকই আঁকুন!
‘কাম্মি শাপুর’!
গায়ক কিশোরকুমার নিয়ে লেখা বহু বইয়ের উপজীব্য। তাঁর গানের তালিকা বা সুরকার হিসাবে যাঁদের সঙ্গে কাজ করেছিলেন তাঁদের মতামত, খুঁজলে পাওয়া যায়। এতটা বিশদে নয়, ঠিক। কিন্তু ‘কিশোরকুমার: দ্য আল্টিমেট বায়োগ্রাফি’ যেখানে একেবারেই আলাদা, কিশোরের সিনেমাজীবনের প্রসঙ্গ। যেহেতু ‘জীবনী’, অনিরুদ্ধ–পার্থিব কিশোরজীবনের এই প্রায় অনালোচিত দিক তুলে ধরেছেন মুন্সিয়ানায় এবং শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব ছবির পাশাপাশি কোন্ কোন্ ছবি ঘোষিত হয়েও কেন বেরতে পারেনি, ঘটনাগুলোও। যাঁদের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন, নায়িকারা প্রত্যেকেই জানিয়েছিলেন, রোমান্টিক দৃশ্যে একেবারেই স্বচ্ছন্দ্য ছিলেন না কিশোর। আড়ষ্ট থাকতেন, আবার অন্য দৃশ্যে সাবলীল।
আরাধনা পরবর্তী অধ্যায়ে গায়ক কিশোরের যে ব্যস্ততা তারই সমান কিংবা তার চেয়েও বেশি ব্যস্ততা একসময় ছিল সিনেমা নিয়ে, যখন তিন শিফ্টেই কাজ করতে হয়েছিল তাঁকে। শুরুতে অভিনয়ের ব্যাপারে ঘোর বিরোধী থেকে এক স্টুডিও থেকে আর এক স্টুডিওয় যাতায়াতের সেই দিনলিপিও তুলে এনেছেন দুই লেখক। সঙ্গে কিশোরের অমর উক্তি, ‘বোকা–বোকা (স্টুপিড) বলা হয় যে ছবিগুলিকে, আমি অভিনয় করে যেতে চাই সেই সব ছবিতেই। বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন (সেনসিবল) ছবিতে নয়। যে ছবির গল্পে অসঙ্গতি যত বেশি বা যত অবাস্তব, বেশিদিন চলে। আর বুদ্ধিদীপ্ত হলেই হল থেকে উঠে যায় চটপট! তেমন ফ্লপ ছবিতে কাজ করার থেকে স্টুপিড ছবিতে কাজ করা ঢের ভাল।’ (পৃষ্ঠা ১৮৬)
সঙ্গে ছিল ‘জিব্বারিশ’। অর্থহীন ছন্দমিলযুক্ত কিছু শব্দ তাড়াতাড়ি বলা যা তাদের অর্থহীনতার কারণে হাসির উদ্রেক ঘটায়। ‘বম চিকা বম’ গোছের শব্দগুচ্ছ। বাংলায় ‘শিং নেই তবু নাম তার সিংহ’ গানে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার যেমন ঢেলে সাজিয়ে দিয়েছিলেন কিশোরের মনের মতো করে — ‘টক টক টক টক টরেটক্কা, আর কত দূরে বোগদাদ মক্কা’ বা ‘লাগে ঝুড়িঝিড়ি সুড়সুড়ি হ্যাঁচ্চো হ্যাঁচ্চো ছিক ছিক ছিক ছিক’ ইত্যাদি। অর্থহীন না হলেও এই এলেমেলো–কথন খুব পছন্দ ছিল কিশোরের। হিন্দিতেও বেশ কিছু পরিচিত, সুপারহিট গানে কিশোর মাঝেমাঝেই গেয়েছেন সেসব, গীতিকার–সুরকারের পরোয়া না–করে।
অনিরুদ্ধ–পার্থিব অবশ্য আরও কিছু ঘটনা বলেছেন তাঁর ছোটবেলার যা বিস্ময়কর। একবার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারছিল কিশোর, স্কুলজীবনে। সেই সময়ের বিখ্যাত গান ‘দিল জ্বলতা হ্যায় তো জ্বলনে দে’। কিশোর হঠাৎ গেয়ে উঠেছিল, ‘লদি তালজ হ্যায় তো নেলজ দে’। বন্ধুরা অবাক, চেনা সুর সত্ত্বেও গানটা যেন ধরা যাচ্ছে না। সে–কথা বলতেই কিশোরের অট্টহাসি, ‘আরে বুদ্ধুরা, ওই দিল জ্বলতা হ্যায় তো গানটাই তো গাইছি, শব্দগুলো পাল্টে, শেষের অক্ষরটা আগে নিয়ে এসে, উল্টে দিয়ে।’ এবং, এ–কাজে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তার প্রমাণ — বন্ধু শাম্মি কাপুরকে কিশোর ডাকতেন ‘কাম্মি শাপুর’! আর শাম্মির প্রত্যুত্তর ছিল ‘শিকোর রমাকু’ বা ‘শুমার’।
ট্রিভিয়া বা ছোট তথ্যের আরও দুটি —
* কিশোরের প্রথম ‘আইটেম সং’ ছিল অসিত সেনের পরিবার ছবিতে ‘কুয়েমেঁ কুদকে মর যানা’। গানের শুরুতে নিখাদ বাঙালি উচ্চারণে ‘ঠাণ্ডা জলমে নাহানেসে গলাঠো যরা বৈঠ গ্যয়া’ পর্দায় শ্রোতাদের যেমন, আজও সেই গানের দর্শক বা শ্রোতাদের সমান আনন্দ দেয়।
* ১৯৪২–৪৩, দাদামণি কিশোরকে নিয়ে গিয়েছিলেন অল ইন্ডিয়া রেডিওতে, অডিশন দিতে। কিশোর যেতে চাননি, কেঁদেছিলেন চিৎকার করেই। পরে অবশ্য বাধ্য হয়েছিলেন যেতে। সেই অডিশন ‘কনডাক্ট’ করেছিলেন মদনমোহন, পরে যিনি সুরকার হিসাবে জগদ্বিখ্যাত হবেন, আর তবলায় ছিল জনৈক বালক যার পোশাকি নাম রাজ কাপুর!
‘এক চুটকি সিন্দুরকি কিমত...’
এক চুটকি সিন্দুরকি কিমত তুম কেয়া জানো ‘কিশোর’বাবু!
ওম শান্তি ওম সিনেমায় রমেশবাবু ওরফে শাহরুখ খানের জন্য কথাগুলো বলেছিলেন দীপিকা পাড়ুকোন। প্রকাশকন্যার অভিষেক সিনেমায় ‘ডায়ালগ’ লিখেছিলেন ময়ূর পুরী। কোরিওগ্রাফার ফারহা খানের প্রথম পরিচালিত সেই সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে দেখা গিয়েছিল ২০০৭ সালে।
কিন্তু, ‘এক চুটকি সিন্দুর’–এর জন্ম কি অন্তত আরও বছর পঞ্চাশ আগে, মধুবালার কণ্ঠে, কিশোরকুমারের জন্য, কোনও এক আবেগঘন মুহূর্তে?
প্রমাণ করা কঠিন। তবে, ‘কিশোরকুমার: দ্য আলটিমেট বায়োগ্রাফি’ কিছু তথ্য তুলে ধরেছে, যা তেমন ভাবতে বাধ্য করে।
২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৭ সালে মরাঠি পত্রিকা ‘মাধুরী’–তে ইসাক মুজাবর লিখেছিলেন ‘মধুবালা — ও বেওয়াফা নহি মজবুর থি’। সাতাশির ১৩ অক্টোবরের বিকেল তখন খানিক দূর। সিনে–সাংবাদিক মুজাবরের লেখা থেকে অনিরুদ্ধ–পার্থিব তুলে এনেছিলেন যা, ইংরেজি থেকে বাংলায়, মধুবালার কথায়, ‘কিশোর, তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। কিন্তু যার হাতে বেঁচে থাকার আর কয়েকটা দিনই আছে শুধু, তাকে বিয়ে করে তোমার তো হারানোর কিছু নেই। আমার একমাত্র ইচ্ছে সিঁথিতে সিঁদুর নিয়ে মৃত্যু।’
মধুবালার জন্ম মুমতাজ জাহান বেগম দেহলভি হয়ে, বাবা আতাউল্লা খান দেহলভি ও মা আয়েশা বেগম। তাঁকে ‘মধুবালা’ করেছিলেন পরিচালক মোহন সিনহা, সম্পর্কে যিনি অভিনেত্রী বিদ্যা সিনহার মামা। ১৯৪৭ সালে বেরনো তাঁর ‘চিতোর বিজয়’ ও ‘দিল কি রানি’ ছবির প্রয়োজনে, নায়িকার নাম বদলে দিয়ে। যদিও তখনকার বোম্বে ফিল্ম–দুনিয়ায় প্রচলিত মত ছিল, নাম বদলে দিয়েছিলেন দেবিকা রানি। মানেননি দুই লেখক। তাঁরা কৃতিত্ব দিয়েছেন মোহনকেই। সে অন্য প্রসঙ্গ।
কিন্তু মধুবালা, মুমতাজ হয়ে যাঁর জন্ম এবং জীবিতাবস্থায় যিনি ধর্ম পরিবর্তন কখনও করেননি, ‘সিঁথিতে সিঁদূর’ নিয়ে মারা যাওয়ার এমন এক সতীলক্ষ্মী হিন্দু এয়ো স্ত্রীর বাসনা ব্যক্ত করবেন কেন? যে সংলাপ তুলে ধরা হয়েছে, নিশ্চিতভাবেই একান্ত। মধুবালা–কিশোরের সেই সাক্ষাতের কথা সাংবাদিক ইসাক জানতেই পারেন, কানে–শোনা হতে পারে না, অসম্ভব। ঘটনাটা বুঝে এই সংলাপ তাই ইসাকের ‘কার্ডাসীয়’ রচনা। পিচের ওপর দুই ব্যাটসম্যানের বাক্যালাপ যেভাবে ‘লিপিবদ্ধ’ করতেন ক্রিকেটলেখায় কিংবদন্তি নেভিল কার্ডাস। হিন্দি ছায়াছবির সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে থাকার কারণে ইসাকের লেখাতেও তখনকার সিনেমার প্রত্যক্ষ প্রভাবে এমন শেষইচ্ছেয় মধুবালার সিঁথিতে সিঁদুর। আর, সেই কারণেই, আরও একটু এগিয়ে (বা পিছিয়ে!) ‘এক চুটকি সিন্দুর’–এর কৃতিত্বও তা হলে কেন দেওয়া যাবে না মুমতাজ ওরফে মধুবালাকে!
৫৫৬–পাতার বইয়ের পাতায় পাতায় এমন ‘এক চুটকি সিন্দুর’। লিখে রাখতে শুরু করলে শেষে লেখার খাতাটাও বইয়ের কাছাকাছি মাপে পৌঁছে যায়! অনিরুদ্ধ ভট্টাচার্য এবং বালাজি ভিট্টল কয়েক বছর আগে ‘আরডি বর্মন: দ্য ম্যান, দ্য মিউজিক’ লিখে রাষ্ট্রপতি পুরস্কারের স্বর্ণকমল পেয়েছিলেন। পার্থিবের সঙ্গে জুটিতে এবার কিশোরকে নিয়ে লিখে আবারও রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পুরস্কার পেলে অবাক হবেন না যেন।
রাষ্ট্রীয় সম্মান কিশোরের জোটেনি। উল্টে দেশজুড়ে ‘জরুরি অবস্থা’র সময় ইন্দিরা গান্ধীর পুত্র সঞ্জয়ের কারণে তাঁকে সর্বভারতীয় বেতার সংস্থা এবং দূরদর্শন থেকে নির্বাসিত করা হয়েছিল। এমনও হয়েছিল, দ্বৈতগানে কিশোরের অংশ নীরব করে অন্য গায়ক বা গায়িকার গলায় শোনা যেত বাকি গান। সেই ইতিহাসেরও তথ্যনিষ্ঠ বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন অনিরুদ্ধ–পার্থিব।
তাই, এই বই রাষ্ট্রীয় সম্মান পেলে কিশোরভক্তরা আনন্দে গলা ছেড়ে আবারও গাইবেন, ‘জানি না, কেন যে, বাজে সে সুর বুকে’!
***
গান গেয়েছেন অনেক বেশি ছবিতে। সঙ্গে, ৮৯টি হিন্দি ছবিতে কাজ করেছিলেন অভিনেতা কিশোর। বাংলার চারটি (লুকোচুরি, মধ্যরাতের তারা, একটুকু ছোঁয়া লাগে এবং দুষ্টু প্রজাপতি) মিলিয়ে মোট ৯৩ ছবিতে পর্দায় দেখা গিয়েছে তাঁকে, জানিয়েছে ‘বৈশাখী’–র কিশোরকুমার বিশেষ সংখ্যা, যেখানে সম্পাদক ধ্রুবজ্যোতি মণ্ডলের সঙ্গে অতিথি সম্পাদক হিসাবে কাজ করেছেন দুই কিশোর–অনুরাগী জ্যোতিপ্রকাশ মিত্র ও সঞ্জয় সেনগুপ্ত। ৪২ আধুনিক, ১৪৮ সিনেমার গান মিলিয়ে মোট ১৯০ বাংলা গান ও ২৪ রবীন্দ্র সঙ্গীতের দুটি অ্যালবাম। প্রতিটি গানের রেকর্ডের নম্বর ও তারিখসহ।
নায়ক–গায়কের ৩৫তম প্রয়াণ বর্ষে বেরনো ২৯২ পাতার এই বই আসলে সংকলন। কিশোরকুমার সম্পর্কে বিদগ্ধদের মতামত। আর রয়েছে কিশোরভক্তরা যা খুঁজে বেড়ান রোজ। লতা মঙ্গেশকারের নেওয়া কিশোরের সাক্ষাৎকার, প্রীতীশ নন্দীর নেওয়া ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকার, লতা–আশা কী বলতেন কিশোর সম্পর্কে, সলিল চৌধুরি, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং অবশ্যই সত্যজিৎ রায়ও। সঙ্গে গায়ক, সুরকার ও পরিচালকদের কথা, বাংলায় মুকুল দত্ত ও কিশোরকুমারের সম্পর্কের কথা। বহু গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ দু–মলাটে। সেরা হিন্দি সোলো এবং লতা–আশা ছাড়াও হিন্দিতে আরও যাঁদের সঙ্গে দ্বৈতগান গেয়েছিলেন, সংক্ষিপ্ত তালিকা। ৩০০ টাকায় দুর্দান্ত সংগ্রহ!
অতিথি সম্পাদকদের কাছে ছোট্ট অনুযোগ তবুও। ফিল্মফেয়ার পত্রিকা ১৯৫৬ সালে কিশোরকুমারের অভিনব সাক্ষাৎকার ছেপেছিল। ফিল্মজগতে তখনকার ‘তারকা’ কিশোরকুমারের সেই সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন ‘কিশোর গাঙ্গুলি’ নামের কমবয়সি তরুণ। হ্যাঁ, কিশোরকুমারের নেওয়া কিশোরকুমারেরই সাক্ষাৎকার! স্থান-কাল-পাত্র বলে শুরু হওয়া সেই লেখা আসলে তাঁর ‘অল্টার ইগো’-র সঙ্গে ‘স্টার’ কিশোরকুমারের মনখুলে কথা। গত ৬৯ বছরে, এমন ভাবতেই পারেননি আর কেউ। আসলে, কিশোরকুমার একবার ভেবে ফেলার পর কেউ কেউ এমন ভাবতে চাইলেও সামনে দাঁড়িয়ে পড়তেন সেই কিশোরই। তাঁর গান ‘কপি’ তো হয়েছেই, তাঁর ভাবনাও টুকব, ভেবেই হয়ত নিজেকে নিরস্ত করেছিলেন ‘বিখ্যাত’ কেউ। তাই কিশোর থেকে গিয়েছেন অদ্বিতীয়। এই সংকলনে সেই সাক্ষাৎকারটাও থাকলে পূর্ণ হত ষোলকলা।
● ‘কিশোরকুমার: দ্য আল্টিমেট বায়োগ্রাফি’, অনিরুদ্ধ ভট্টাচার্য–পার্থিব ধর, হার্পার কলিন্স, ৬৯৯ টাকা
● বৈশাখী, কিশোরকুমার বিশেষ সংখ্যা, সম্পাদক ধ্রুবজ্যোতি মণ্ডলের সঙ্গে অতিথি সম্পাদক জ্যোতিপ্রকাশ মিত্র ও সঞ্জয় সেনগুপ্ত, ৩০০ টাকা
* আজকাল রবিবাসর, ৩০ জুলাই ২০২৩ প্রকাশিত