Friday, October 13, 2023

কাশীনাথ ভট্টাচার্য / প্রতিবন্ধক-ইডেন!


স্টোরিটা কাতার থেকে করেছিল বর্তমানের সোমনাথ বসু। বলামাত্রই পাঠিয়ে দিল, ধন্যবাদ দিয়ে ওকে ছোট করব না। প্রিন্ট মিডিয়ার এটাই সুবিধা, চাইলেই পাওয়া যায়, পড়া যায়, লিপিবদ্ধ রাখাও যায়, সহজে। এমন স্টোরিই তো লিখে রাখতে হয় রে সোমনাথ!

কাতার বিশ্বকাপের আসরে গিয়ে দেখা পেয়েছিলাম নিকোলাস দানিয়েল রোদরিগেস-এর। দোহার মিডিয়া সেন্টারে। হুইল চেয়ার নির্ভর সাংবাদিক প্রেস সেন্টারে দেখতে পাওয়া যায় না সচরাচর। তার ওপর ফিফা বিশ্বকাপে যেখানে এত ঘোরাঘুরি, হাঁটাহাঁটি। ফিট না থাকলে ওই ৩৪-৩৫ দিনের ধকল সামলানোটাও সহজ নয়। নিকোলাস আবার এসেছিলেন মোনতেভিদিও থেকে কাতারে। দূরত্ব, গুগল জানাল, তের হাজার একশো সতের (১৩,১১৭) কিলোমিটার!

সে না হয় বিমানে এলেন। বিমানে হুইল চেয়ার তোলা-নামানোর ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু, তারপর?

প্রতিটি স্টেডিয়ামে যাওয়ার জন্য ফিফা বাস দিয়েছিল। মিডিয়া সেন্টার থেকে সেই বাস ছাড়ত এবং পৌঁছনো যেত স্টেডিয়ামে। সেখানে নেমেও কতটা যে হাঁটতে হত, যাঁরা গিয়েছিলেন, জানেন। নিকোলাসের সঙ্গী ছিলেন এসিলদো (Hesildo)। আরও এক সাংবাদিক, যিনি প্রতি পদে বন্ধুকে নিয়ে হেঁটেছিলেন, বন্ধুর বিশ্বকাপ ফুটবল দেখা ও লেখার আনন্দ ভাগ করে নিয়েছিলেন সর্বদা পাশে থেকে, হুইলচেয়ার ঠেলে। কুর্নিশ তাঁকেও। এমন বন্ধুত্বও ভাবায়, অনুপ্রেরণা জোগায়।

ফিফাকে ধন্যবাদেরও ভাষা নেই, বিশেষভাবে সক্ষম নিকোলাসকে বিশ্বকাপের অ্যাক্রিডিটেশন দিতে দ্বিধা করেনি বলে। বিশেষভাবে সক্ষম হওয়া, চলাফেরায় অসুবিধা, নিকোলাসের দেখা এবং লেখার প্রতিবন্ধক ছিল না। তাই দেওয়া হয়েছিল অ্যাক্রিডিটেশন। তাঁর সমস্যার সমাধান করেছিলেন নিকোলাস, তাঁর মতো করে, পাশে এসিলদোকে পেয়ে।

তবুও, এই সবই সম্ভব হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ, স্টেডিয়ামের মিডিয়া সেন্টার এবং প্রেস বক্স বা প্রেস গ্যালারিতে পৌঁছতে লিফটের সুবন্দোবস্ত। পাঁচ-ছ’তলার কম কোনওটাই নয়, সিঁড়ি বেয়ে নিকোলাসকে নিয়ে যাওয়া সম্ভবই ছিল না। যদি তেমন হত, নিকোলাস কোনও ম্যাচই দেখতে পেতেন না, প্রেস সেন্টারে যাওয়ার সুযোগ পেতেন না।

আমার বর্তমান পায়ের অবস্থায় তাই মনে পড়ল নিকোলাসের কথা।

পায়ে প্লাস্টার নিয়ে আমার পক্ষে এখন ইডেনের প্রেস বক্স বা মিডিয়া সেন্টার, কোত্থাও যাওয়া সম্ভবই নয়! দু’জায়গাতেই পৌঁছতে হয় সিঁড়ি বেয়ে। লিফট নেই। অর্থাৎ আমি যদি হুইল চেয়ার কিনে গাড়িভাড়া করেও ইডেনে পৌঁছে যাই, আমার পক্ষে প্রেস বক্সে বসে ম্যাচ দেখা-লেখা সম্ভব হবে না। সিএবি-র দোতলা পর্যন্ত একটা লিফট আছে আধিকারিকদের জন্য। সেটা এই অবস্থায় আমাকে ব্যবহার করতে দিতে কেউই আপত্তি করবেন না, জানি। মিডিয়া-নির্দিষ্ট গেট থেকে সেই লিফট ব্যবহারের জায়গায় যেতে পারা যায় না অন্যসময়, এখন আমার অবস্থা দেখে সেটাও সমস্যা হবে না। কিন্তু তারপরও যত সিঁড়ি ভাঙতে হবে, হুইলচেয়ার নিয়ে সম্ভব নয়। হুইলচেয়ার চালানোর, টেনে তোলা বা নামানোর মতো কোনও ব্যবস্থাই যে নেই!

হ্যাঁ, এত কষ্ট করে ম্যাচ দেখতে যাওয়ার কী আছে, প্রশ্ন আসবেই। আমি যাচ্ছি না, যেতে চাইছিই না, কারণ খুব ভাল করে জানি যে, অসম্ভব! যেখানে লেখার কথা, জানিয়ে দিয়েছি, পারছি না আপাতত। মেনে নিয়েছেন। সমস্যা কোত্থাও নেই।

তবুও প্রশ্নগুলো থাকছে। পায়ে ভর দিয়ে চলতে পারছি না অ্যাক্সিডেন্টের কারণে। আমার মাথা-হাত, অন্য পা, চোখ সব ঠিক আছে। দেখতে, লিখতে কোনও অসুবিধা নেই। বাড়িতে বিছানায় বসে তো লিখেই চলেছি নিয়মমতো। আমি যেহেতু খেলতে নামছি না, এই নিজে নিজে চলতে না-পারাটা কোনও অর্থেই আমার ম্যাচ দেখা এবং লেখার প্রতিবন্ধক নয়। নিকোলাসের সমস্যাগুলোর কাছাকাছিই নয়, কোনওভাবেই। তবু নিকোলাস পেরেছিলেন ফিফা বিশ্বকাপে কাতারে হাজির থাকতে, উরুগুয়ে থেকে এসে আর আমি যেতে পারব না আইসিসি বিশ্বকাপের খেলা দেখতে মাঠে, নিজের শহরে, বিশ্বকাপের অ্যাক্রিডিটেশন থাকা সত্ত্বেও!

এমনটা না হলেই ভাল হত না প্রিয় ইডেনে?

Thursday, September 28, 2023

বাজে সে সুর বুকে

কিশোরফিল্মের চপলতা আর কিশোরগানের পাগলপারা সুরদরিয়ায় অবগাহন, দুটি বই পড়তে গিয়ে কৈশোরের কিশোরপ্রেমে ফের মাতোয়ারা

কাশীনাথ ভট্টাচার্য


‘‌মাত্র একটাই বই পড়ার চেষ্টা করেছিলাম। দিয়েগোর আত্মজীবনী ইয়ো সোই। শেষ করতে পারিনি!‌’‌

লিওনেল মেসির স্বীকারোক্তি। বই পড়তে তাঁর মোটেও ভাল্লাগে না। তাই আদর্শ মারাদোনার আত্মজীবনী এবং মাতৃভাষা স্প্যানিশে লেখা হলেও, নিজের ওপর জোর খাটাননি। সমস্যা এল বিদ্বৎসমাজ থেকে। কী অশিক্ষিত রে বাবা!‌ লন্ডন টাইমস না ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান, কোন্ কাগজে পড়েছিলাম এখন আর মনে নেই, নিবন্ধকারের জ্বালাময়ী লেখায় জুড়ল অবশ্যম্ভাবী — এত টাকা, কিন্তু শিক্ষার বহরটা দ্যাখো। জীবনে হয়ত আট–‌দশহাজারি বই পড়ুয়ার সে কী শিক্ষার গুমোর!‌

বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ভাষায় হাজার–‌হাজার বইয়ের বিষয় হয়ে উঠবেন যিনি, লক্ষ–‌লক্ষ শব্দ লেখা হবে যাঁকে নিয়ে, সেই মেসিকে বই পড়তেই হবে, এই ‘‌খাপ’‌ কেন যে বসে বিশ্বজুড়ে‍‌!

কিশোরকুমারকে নিয়েও হাঁটা অনেকটা একই পথে। ‘‌প্রথাগত সঙ্গীতের তালিম ছিল না’‌, তাঁকে নিয়ে লিখতে গেলেই অবশ্যম্ভাবী উল্লেখ। ‌তাই নমক হালাল–‌এ ‘‌পগ ঘুঙরু বাঁধ মীরা নাচি থি’‌ গানের সরগম গাওয়ানো হয় পণ্ডিত সত্যনারায়ণ মিশ্রকে দিয়ে, যিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কুশলী শিল্পী। বোঝানোর চেষ্টা, ‘‌ওটা কিশোরের কম্মো নয়’‌!‌‌

অথচ, ‘‌তুমি ছাড়া আর কোনও কিছু ভাল লাগে না আমার‌’‌ এবং ‘‌ভালবাসার আগুন জ্বেলে কেন চলে যায়’‌ মুকুল দত্তের কথা ও লতা মঙ্গেশকারের কণ্ঠে যে গানদুটি শুনে আমাদের বড়–‌হওয়া, সুরে সাজিয়েছিলেন কিশোরকুমার। প্রথাগত শিক্ষা না–‌থাকা সত্ত্বেও!‌ হিন্দি ছায়াছবির সুরের ‌জগতে খুঁজলে প্রথমেই মনে পড়বে ‘‌আ চলকে তুঝে’। ছেলে অমিতের হাত ধরে শ্রোতাদেরও নিয়ে গিয়েছিলেন ‘‌এক অ্যায়সি গগনকে তলে, যঁহা গম ভি না হো, আঁসু ভি না হো, ব্যস প্যায়ার হি প্যায়ার পলে’‌‌। কবীর সুমন যেমন বলেছিলেন গানে, ‘‌জানি না কাঁদায় কেন সহজ সুরের শয়তানি’‌। কিশোরের এই ‘‌সহজ সুরের শয়তানি’ সহজাত, সঙ্গীতে ‘‌অশিক্ষিত‌’‌ হয়েও।‌‌‌

তাই প্রথাগত সঙ্গীতের তালিম ছিল না, ক্রমাগত এই উল্লেখের মাধ্যমে তাঁকে খাটো করে দেখাতে চাওয়ার কারণ বোঝা কঠিন।‌ উল্টো প্রশ্নগুলো কেন করা হয় না, যেমন,‌ ‌সঙ্গীতের প্রথাগত শিক্ষা আছে যাঁদের, কেন তাঁরা হয়ে উঠতে পারলেন না কিশোরকুমার?‌‌ কেন প্রয়াণের ৩৬ বছর পরও তাঁকে নিয়েই চর্চা?‌ কেনই বা রেডিও–‌টিভি–‌রিয়েলিটি শো এখনও মজে কিশোরেই, ‘‌শিক্ষিত’‌ শিল্পীদের গানে ততটা নয়?‌



হার্পার কলিন্স থেকে প্রকাশিত অনিরুদ্ধ ভট্টাচার্য ও পার্থিব ধরের লেখা ৫৫৬ পাতার বই ‘‌কিশোরকুমার:‌ দ্য আল্টিমেট বায়োগ্রাফি’‌ সরাসরি এই প্রসঙ্গে বিশেষ চর্চা না করেও অন্য রাস্তায় শুরু থেকেই। কিশোরকে নিয়ে লেখা বইয়ের প্রতিটি অধ্যায় সাজানো হয়েছে রাগ–‌রাগিণীর নামে;‌ জোগিয়ায় শুরু, কেদারে শেষ। বই জানিয়েছে কিংবদন্তি সুরকার নৌশাদের উষ্মার কথাও। ‘‌আজকালকার গান?‌ ওই তো আরডি (‌বর্মন)‌ সুর দেয় আর কিশোর গায়’ (‌পৃষ্ঠা ৩৬৫)‌। বাঙালি হলে ‘‌পাতে দেওয়ার যোগ্য নয়’‌ জুড়ে দিতেন, নিশ্চিত!‌ বিদ্রুপের সঙ্গেই চূড়ান্ত হতাশাও সঙ্গী তখন নৌশাদের।‌ তাঁকে বাদ দিয়ে আরডি–‌র হাতে সুরের দায়িত্ব আর তাঁর প্রিয় মহম্মদ রফিকে ছেড়ে কিশোরকে দিয়ে গাওয়ানোর ‘‌ট্রেন্ড’‌ — একেবারেই মানতে না পেরে এই ‘‌শিক্ষিত’‌ বিষোদ্গার।‌ মুশকিল, শিক্ষায় বিদ্রুপ–‌বিষোদ্গার সর্বদা পরিত্যজ্য, পরিহার্য।

১৯৮৭ সালের ১৫ নভেম্বর মনোরমায় লক্ষ্মীরাম চৌধুরির লেখা তুলে এনেছেন দুই লেখক, যেখানে নৌশাদের ওই বক্তব্যের পরই বলা ছিল, ‘‘‌‌ভেতরে তখন নৌশাদের মেয়ে গাইছিলেন চন্দা ও চন্দা, কিশোর–‌লতার ডুয়েট, ১৯৭১ সালের ‘‌লাখো মে এক’ ছবিতে। সুর অবশ্যই আরডি–‌র।’’‌ এরপর কিছু বলা সত্যিই বাহুল্য‍‌!‌

‘‌পড়োশন’ সবারই মনে আছে। ‘‌এক চতুর নর’‌ গানে মেহবুবরূপী মান্না দের সঙ্গে কিশোরের গানের লড়াই প্রসঙ্গও বহুচর্চিত। মান্না নিজেই জানিয়েছিলেন, রেকর্ডিংয়ের সময় কিশোর হঠাৎ ‘‌ওয়ে টেরে, সিধে হো যা রে’‌ গেয়ে ফেলেছিলেন তাৎক্ষণিক বুদ্ধিমত্তায়, ফিল্মি সিচুয়েশনের সঙ্গতি রেখে, আপন মনের মাধুরী মিশায়ে। ওই লাইনটা লেখা ছিল না। ‌‌‌‌‌হতচকিত মান্না তখন কাচের দেওয়ালের বাইরে দাঁড়ানো পঞ্চমের দিকে ইশারা করে জানতে চেয়েছিলেন, কী হচ্ছে এসব?‌ পঞ্চমও হাত নেড়ে মান্নাকে ওই সব উপেক্ষা করে গান গেয়ে যেতে বলেছিলেন, ইশারায়ই। মান্না পরে বলবেন, ‘‌আমি তো গায়ক হিসাবে গাইছিলাম আর কিশোর গাইছিল সিনেমায় ওই পরিস্থিতির কথা ভেবে, ভেতর থেকে। সেই দিন থেকেই ওকে জিনিয়াস হিসাবে মেনে নিতে দ্বিধা করিনি।’‌ (‌পৃষ্ঠা ৩৪৪)

কিশোরের সাঙ্গীতিক মনন হয়ত তাঁর গায়কসত্তার প্রতি হয়ে–‌চলা প্রতিনিয়ত অসম্মানের সেই দিনগুলোর ভাবনায় এতটাই ব্যথিত ছিল যে, ঠিক সময়ে, সুযোগবুঝে গানের মাঝেই গুঁজে দিয়েছিলেন তাঁর অমোঘ বার্তা, তখনকার দিনের গানের প্রতি — ‘‌ওয়ে টেরে, সিধে হো যা রে’‌!

তাঁকে এই ‘‌সিধে’‌ গাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন একমেবাদ্বিতীয়ম শচীন দেববর্মন। আদেশ ছিল শচীনকত্তার, ‘‌সোজা গাইবি। দরদ দিয়ে, আবেগ দিয়ে। কথাগুলো জটিল করে তুলবি না।’‌ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন কিশোর, জীবনজুড়ে। একেবারে শুরুতে খেমচাঁদ প্রকাশের পর এসডি–‌ই ভরসা রেখেছিলেন তাঁর গলায়, গানে। যখন এমনকি দাদা অশোককুমারও গায়ক কিশোরের দক্ষতায় আস্থা রাখতে পারেননি, ভাইকে বলতেন গান ছেড়ে অভিনয়ে সময় দিতে, এসডি বুঝিয়েছিলেন দাদামণিকে, গান দিয়ে বাজিমাতের ক্ষমতা আছে কিশোরের। কথিত, ১৯৫৪ সালে বেরনো ‘‌মুনিমজী’‌ ছবির ঘটনা, সাহির লুধিয়ানভির কথায় ‘‌জীবন কে সফর মে রাহি‌’‌ গানের রেকর্ডিং–‌এর পর দাদাবর্মন চমকে দিয়েছিলেন সবাইকে। গান শেষ হওয়ার পরই শচীনকত্তার চিৎকার, ‘‌থাম্ থাম্, চুপ কর্ সবাই’। স্তব্ধ সবাই চকিতে। নিশ্চয়ই ভুল করেছে কেউ, আশঙ্কায় বিড়বিড়। দাদাবর্মন তারপর সোজা কিশোরের কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘‌কী গাইলি রে, দুর্দান্ত!‌ তুই যদি এভাবেই গেয়ে যাস, আমার গান হিট হবেই।’‌ (‌পৃষ্ঠা ১৬৬)‌


রোল নম্বর ৪১৯৭

প্রীতীশ নন্দীর ভূমিকায় সমৃদ্ধ অনিরুদ্ধ–‌পার্থিবের ‘‌কিশোরকুমার:‌ দ্য আল্টিমেট বায়োগ্রাফি’র পাতায় পাতায় তথ্যবিস্ফোরণ।‌ বহু ‘‌মিথ’‌ ভেঙেছেন গবেষণায়। আর পাঠককে জুগিয়েছেন নতুন তথ্য যা তাঁদের সঙ্গী হবে অলস ভাবনাবিলাসে। অধুনা প্রচলিত রীতি, পুরনো কয়েকটা কাগজ থেকে কিছু লেখার অংশবিশেষ তুলে ধরলেই ‘‌গবেষণালব্ধ’ বিশেষণ জুড়ে–‌দেওয়া‌। অনিরুদ্ধ–‌পার্থিবের গবেষণার কিছু নমুনা তুলে ধরা যাক। 

ধরা যাক, আপনি কিশোরকুমার সম্পর্কে অনেক কথা জানেন। স্বাভাবিক, আপনি কিশোর–‌ভক্ত। হয়ত, অভিনেতা কিশোরেরও। তাই অভিনীত কিছু ছবি এবং তার গান ইত্যাদি নিয়ে পড়েছেন, শুনেছেন, মনেও রেখেছেন। ভক্তের কাজ সেখানে শেষ, গবেষকের শুরু। অনিরুদ্ধ–‌পার্থিবের এই কিশোর–‌অণ্বেষণ পড়তে পড়তে মনে হওয়া স্বাভাবিক, আপনার মনে রয়ে–‌যাওয়া কিশোর তথ্যভাণ্ডার কৈশোর ছেড়ে যৌবরাজ্যেই পা ফেলেনি‍‌!‌

‌তথ্য খুঁজতে কত দূর যেতে পারেন জীবনীকার?‌ যুগ্ম লেখকের অন্যতম পার্থিব মধুচন্দ্রিমায় গিয়েছিলেন খান্ডোয়া!‌ নববধূর সঙ্গে পথচলা শুরু তাঁর জীবনের গুরুর আদি বাসস্থান ও শহরে। ‘‌অ্যাকাডেমিক‌’‌ জীবনী বেশি কেন, পড়িইনি প্রায়। তাই জানা নেই এমন সেখানে হয় কিনা। কিশোরকুমারের জীবনী জানাচ্ছে, ‘‌হিন্দি মাধ্যমে নাগপুর বোর্ডের সেকেন্ডারি পরীক্ষায় বসেছিল কিশোর, ১৯৪৬ সালে। ৮০০–‌য় ৩২৬, পাস করেছিল ৪০.‌৭৫ শতাংশ নম্বর পেয়ে। রোল নম্বর ৪১৯৭। তারপর স্কুল থেকে টিসি পেয়েছিল ২৪ জুন ১৯৪৬। সেই টিসি–‌র নম্বর ২৪৩। ওই স্কুলের খাতায় জন্মতারিখ ৪ অগাস্ট ১৯৩০।’‌ আর ১৮ জুলাই ১৯৩৯ সালে ভর্তি–‌হওয়া খান্ডোয়ার নিউ হাই স্কুল থেকে পাওয়া শেষ সেই শংসাপত্রে লেখা ছিল, ‘‌টিকা নিয়েছে, ব্যবহারও খুব ভাল।’‌ (‌পৃষ্ঠা ৫০)‌

তখন তাঁর বাবা কুঞ্জিলাল যে–‌নাম লিখেছিলেন, ইংরেজিতেই থাক, বোঝার সুবিধার কারণে — Keshore Kumar Gangoly‌। নামে ‘‌আই’‌ এর জায়গায় ‘‌ই’‌ এবং পদবিতে ‘‌ইউ’‌–‌এর জায়গায় ‘‌ও’‌। ‘‌কেশোর কুমার গাঙ্গোলি’‌। কিশোর আর কুমার আলাদা, একসঙ্গে নয়। ওই নামেই ইন্দোরের ক্রিশ্চিয়ান কলেজের খাতায় অ্যাডমিশন। যেমন নম্বর পেয়েছিলেন, ক্রিশ্চিয়ান কলেজে জায়গা পাওয়া সমস্যা হতে পারে জেনে বাবা চিঠিও লিখে দিয়েছিলেন প্রিন্সিপালকে, দুই ছেলে অনুপ ও কিশোরের জন্য। প্রথম চিঠিতে ছেলেরা কোন ক্লাসে ভর্তি হবে লিখতে ভুলে গিয়েছিলেন বলে পরে দ্বিতীয় চিঠিতে তা–‌ও জানান এবং কুড়ি টাকা জমা দেওয়ার কথাও। অর্থাৎ, বাবার কুড়ি টাকা কলেজ তহবিলে দানের কারণেই অনুপ–‌কিশোর ভর্তি হতে পেরেছিলেন কলেজে, ১৯৪৬ সালের ২১ জুন। ইন্টারমিডিয়েট আর্টস–‌এ ডিগ্রি নিতে, ক্লাসে কিশোর ছিলেন ১২৫তম ছাত্র। আর পড়তে চেয়েছিলেন হিন্দি, সিভিক্স ও ইকোনমিক্স। রেজাল্ট কেমন ছিল কিশোরের?‌ লেখকরা জানিয়েছেন, ‘‌থার্ড ডিভিশনে পাস করে সেকেন্ড ইয়ারে।’‌ সঙ্গে ক্লাস–‌অ্যাটেন্ডেন্স রিপোর্টও!‌ প্রথম বর্ষে ৪২৫–‌এর মধ্যে ৩২৫টি ক্লাসে উপস্থিত ছিলেন কিশোর। বাদ পড়ে যাওয়া ১০০ ক্লাসের বেশিরভাগ সময়ই তিনি বোম্বেতে, তারকা ‌দাদামণির সঙ্গে। অনুসন্ধিৎসা কোথায় কোথায় নিয়ে গিয়েছিল লেখকদের!‌ খুঁজে বের করার পরিশ্রম ও সময়ের কথা ছেড়েই দিন। এভাবে কোনও শিল্পীর স্কুল–‌কলেজের পুঙ্খানুপুঙ্খ রিপোর্ট, পড়েছি কি?‌


বইয়ের সেরা অংশ শুরুর এই দিনগুলোর কথাই। কিশোরের বন্ধু বা তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের মানুষের সঙ্গে কথা বলে তাঁর ছোটবেলার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ। কী করতেন, কীভাবে ছোটবেলা কাটিয়েছিলেন, কী খেতে ভালবাসতেন তখন, কীভাবে সেই ছোটবেলা বারেবারে ফিরে এসেছে তাঁর জীবনে — সব জানিয়েছেন অনিরুদ্ধ–‌পার্থিব। লিখেছেন, কলেজ জীবন থেকেই কিশোরের ‘‌প্লেব্যাক’‌ শুরু! বরাবরই ভাল গাইতেন, কিন্তু এতটাই লাজুক ছিলেন যে, মঞ্চে এসে গাইতে ভয় পেতেন। তাই কলেজের অনুষ্ঠানে থাকতেন পেছনে আর মঞ্চে কেউ একজন তাঁর গানে মুখ নাড়াতেন। অবিকল যেভাবে সিনেমার পর্দায় প্লেব্যাক হয়। ‘‌প‌ড়োশন’‌ মনে পড়ছে না?‌ আবার সেই ‘‌পড়োশন’‌–‌এর নায়ক সুনীল দত্তই ছিলেন নেপথ্যশিল্পীকে মঞ্চশিল্পী করে তোলার প্রধান কারিগর। সেনাবাহিনির ফাংশনে নিয়ে গিয়ে পর্দাঢাকা মঞ্চে কিশোর যখন চোখ বন্ধ করে গেয়ে চলেছেন, সুনীলের নির্দেশে পর্দা উঠে গিয়েছিল এবং দেখা গিয়েছিল কিশোরকুমারকে। তারপর তো মঞ্চশিল্পী কিশোরের কিসসা অগুনতি!‌

রয়েছে তথাকথিত ‘‌কৃপণতা’‌ ‘‌টাকা গোনা’‌ ‘‌পাগলামি’‌র গল্পও। ড্রয়িংরুমে নৌকো ভাসানো আর দেওয়ালের গাছে দাঁড়কাক সাজানোই হোক বা প্রযোজক পয়সা ঠিক সময়ে না–‌দেওয়ায় তাঁকে উত্যক্ত করার ঘটনাগুলো। লেখকদের সাধুবাদ প্রাপ্য, কারণ, যা যা ঘটেছে, যেমনভাবে, কাছাকাছি পৌঁছতে চেয়ে সেই ঘটনাগুলো তুলে ধরেছেন ‘‌জাজমেন্টাল’‌ না হয়ে। লেখকের কাজ সেই জার্নিটা সাবলীল ভাষায় ও সত্যি কথায় তুলে–‌ধরা। পড়ে যা মনে হবে পাঠকের, পূর্ণ স্বাধীনতা তাঁর ভেবে নেওয়ার, ঠিক কেমন ছিলেন কিশোরকুমার। ছবিটা পাঠকই আঁকুন!‌


‘‌কাম্মি শাপুর’‌!

গায়ক কিশোরকুমার নিয়ে লেখা বহু বইয়ের উপজীব্য। তাঁর গানের তালিকা বা সুরকার হিসাবে যাঁদের সঙ্গে কাজ করেছিলেন তাঁদের মতামত, খুঁজলে পাওয়া যায়। এতটা বিশদে নয়, ঠিক। কিন্তু ‘‌কিশোরকুমার:‌ দ্য আল্টিমেট বায়োগ্রাফি’ যেখানে একেবারেই আলাদা, কিশোরের সিনেমাজীবনের প্রসঙ্গ। যেহেতু ‘‌জীবনী’, অনিরুদ্ধ–‌পার্থিব কিশোরজীবনের এই প্রায় অনালোচিত দিক তুলে ধরেছেন মুন্সিয়ানায় এবং শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব ছবির পাশাপাশি কোন্ কোন্ ছবি ঘোষিত হয়েও কেন বেরতে পারেনি, ঘটনাগুলোও। যাঁদের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন, নায়িকারা প্রত্যেকেই জানিয়েছিলেন, রোমান্টিক দৃশ্যে একেবারেই স্বচ্ছন্দ্য ছিলেন না কিশোর। আড়ষ্ট থাকতেন, আবার অন্য দৃশ্যে সাবলীল।

আরাধনা পরবর্তী অধ্যায়ে গায়ক কিশোরের যে ব্যস্ততা তারই সমান কিংবা তার চেয়েও বেশি ব্যস্ততা একসময় ছিল সিনেমা নিয়ে, যখন তিন শিফ্টেই কাজ করতে হয়েছিল তাঁকে। শুরুতে অভিনয়ের ব্যাপারে ঘোর বিরোধী থেকে এক স্টুডিও থেকে আর এক স্টুডিওয়‌ যাতায়াতের সেই দিনলিপিও তুলে এনেছেন দুই লেখক। সঙ্গে কিশোরের অমর উক্তি, ‘‌বোকা–‌বোকা (‌স্টুপিড)‌ বলা হয় যে ছবিগুলিকে, আমি অভিনয় করে যেতে চাই সেই সব ছবিতেই। বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন (‌সেনসিবল)‌ ছবিতে নয়। যে ছবির গল্পে অসঙ্গতি যত বেশি বা যত অবাস্তব, বেশিদিন চলে। আর বুদ্ধিদীপ্ত হলেই হল থেকে উঠে যায় চটপট!‌ তেমন ফ্লপ ছবিতে কাজ করার থেকে স্টুপিড ছবিতে কাজ করা ঢের ভাল।’ (‌পৃষ্ঠা ১৮৬)‌

সঙ্গে ছিল ‘‌জিব্বারিশ’‌। অর্থহীন ছন্দমিলযুক্ত কিছু শব্দ তাড়াতাড়ি বলা যা তাদের অর্থহীনতার কারণে হাসির উদ্রেক ঘটায়। ‘‌বম চিকা বম‌’ গোছের শব্দগুচ্ছ। বাংলায় ‘‌শিং নেই তবু নাম তার সিংহ’‌ গানে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার যেমন ঢেলে সাজিয়ে দিয়েছিলেন কিশোরের মনের মতো করে — ‘‌টক টক টক টক টরেটক্কা, আর কত দূরে বোগদাদ মক্কা’‌ বা ‘‌লাগে ঝুড়িঝিড়ি সুড়সুড়ি হ্যাঁচ্চো হ্যাঁচ্চো ছিক ছিক ছিক ছিক’‌ ইত্যাদি। অর্থহীন না হলেও এই এলেমেলো–‌কথন খুব পছন্দ ছিল কিশোরের। হিন্দিতেও বেশ কিছু পরিচিত, সুপারহিট গানে কিশোর মাঝেমাঝেই গেয়েছেন সেসব, গীতিকার–‌সুরকারের পরোয়া না–করে।

অনিরুদ্ধ–পার্থিব অবশ্য আরও কিছু ঘটনা বলেছেন তাঁর ছোটবেলার যা বিস্ময়কর। একবার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারছিল কিশোর, স্কুলজীবনে‌। সেই সময়ের বিখ্যাত গান ‘‌দিল জ্বলতা হ্যায় তো জ্বলনে দে’‌। কিশোর হঠাৎ গেয়ে উঠেছিল, ‘‌লদি তালজ হ্যায় তো নেলজ দে’‌। বন্ধুরা অবাক, চেনা সুর সত্ত্বেও গানটা যেন ধরা যাচ্ছে না। সে–‌কথা বলতেই কিশোরের অট্টহাসি, ‘‌আরে বুদ্ধুরা, ওই দিল জ্বলতা হ্যায় তো গানটাই তো গাইছি, শব্দগুলো পাল্টে, শেষের অক্ষরটা আগে নিয়ে এসে, উল্টে দিয়ে।’‌ এবং, এ–‌কাজে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তার প্রমাণ — বন্ধু শাম্মি কাপুরকে কিশোর ডাকতেন ‘‌কাম্মি শাপুর’‌!‌ আর শাম্মির প্রত্যুত্তর ছিল ‘‌শিকোর রমাকু’‌ বা ‘‌শুমার’‌।‌

ট্রিভিয়া বা ছোট তথ্যের আরও দুটি —

*‌ কিশোরের প্রথম ‘‌আইটেম সং’‌ ছিল অসিত সেনের পরিবার ছবিতে ‘‌কুয়েমেঁ কুদকে মর যানা’‌। গানের শুরুতে নিখাদ বাঙালি উচ্চারণে ‘‌ঠাণ্ডা জলমে নাহানেসে গলাঠো যরা বৈঠ গ্যয়া’‌ পর্দায় শ্রোতাদের যেমন, আজও সেই গানের দর্শক বা শ্রোতাদের সমান আনন্দ দেয়।

*‌ ১৯৪২–‌৪৩, দাদামণি কিশোরকে নিয়ে গিয়েছিলেন অল ইন্ডিয়া রেডিওতে, অডিশন দিতে। কিশোর যেতে চাননি, কেঁদেছিলেন চিৎকার করেই। পরে অবশ্য বাধ্য হয়েছিলেন যেতে। সেই অডিশন ‘‌কনডাক্ট’‌ করেছিলেন মদনমোহন, পরে যিনি সুরকার হিসাবে জগদ্বিখ্যাত হবেন, আর তবলায় ছিল জনৈক বালক যার পোশাকি নাম রাজ কাপুর!‌


‘‌এক চুটকি সিন্দুরকি কিমত.‌.‌.‌’

‌এক চুটকি সিন্দুরকি কিমত তুম কেয়া জানো ‘‌কিশোর’‌বাবু!

ওম শান্তি ওম সিনেমায় রমেশবাবু ওরফে শাহরুখ খানের জন্য কথাগুলো বলেছিলেন দীপিকা পাড়ুকোন। প্রকাশকন্যার অভিষেক সিনেমায় ‘‌ডায়ালগ’‌ লিখেছিলেন ময়ূর পুরী। কোরিওগ্রাফার ফারহা খানের প্রথম পরিচালিত সেই সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে দেখা গিয়েছিল ২০০৭ সালে। 

কিন্তু, ‘‌এক চুটকি সিন্দুর’–‌এর জন্ম কি অন্তত আরও বছর পঞ্চাশ আগে, মধুবালার কণ্ঠে, কিশোরকুমারের জন্য, কোনও এক আবেগঘন মুহূর্তে?

প্রমাণ করা কঠিন। তবে, ‘‌কিশোরকুমার:‌ দ্য আলটিমেট বায়োগ্রাফি’‌ কিছু তথ্য তুলে ধরেছে, যা তেমন ভাবতে বাধ্য করে।

২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৭ সালে মরাঠি পত্রিকা ‘‌মাধুরী’‌–‌তে ইসাক মুজাবর লিখেছিলেন ‘‌মধুবালা — ও বেওয়াফা নহি মজবুর থি’‌। সাতাশির ১৩ অক্টোবরের বিকেল তখন খানিক দূর। সিনে–‌সাংবাদিক মুজাবরের লেখা থেকে অনিরুদ্ধ–‌পার্থিব তুলে এনেছিলেন যা, ইংরেজি থেকে বাংলায়, মধুবালার কথায়, ‘‌কিশোর, তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। কিন্তু যার হাতে বেঁচে থাকার আর কয়েকটা দিনই আছে শুধু, তাকে বিয়ে করে তোমার তো হারানোর কিছু নেই। আমার একমাত্র ইচ্ছে সিঁথিতে সিঁদুর নিয়ে মৃত্যু।’‌

মধুবালার জন্ম মুমতাজ জাহান বেগম দেহলভি হয়ে, বাবা আতাউল্লা খান দেহলভি ও মা আয়েশা বেগম। তাঁকে ‘‌মধুবালা’‌ করেছিলেন পরিচালক মোহন সিনহা, সম্পর্কে যিনি অভিনেত্রী বিদ্যা সিনহার মামা। ১৯৪৭ সালে বেরনো তাঁর ‘‌চিতোর বিজয়’ ও ‘‌দিল কি রানি’‌ ছবির প্রয়োজনে, নায়িকার নাম বদলে দিয়ে। যদিও তখনকার বোম্বে ফিল্ম‌–‌দুনিয়ায় প্রচলিত মত ছিল, নাম বদলে দিয়েছিলেন দেবিকা রানি। মানেননি দুই লেখক। তাঁরা কৃতিত্ব দিয়েছেন মোহনকেই। সে অন্য প্রসঙ্গ।

কিন্তু মধুবালা, মুমতাজ হয়ে যাঁর জন্ম এবং জীবিতাবস্থায় যিনি ধর্ম পরিবর্তন কখনও করেননি, ‘‌সিঁথিতে সিঁদূর’‌ নিয়ে মারা যাওয়ার এমন এক সতীলক্ষ্মী হিন্দু এয়ো স্ত্রীর বাসনা ব্যক্ত করবেন কেন?‌ যে সংলাপ তুলে ধরা হয়েছে, নিশ্চিতভাবেই একান্ত। মধুবালা–‌কিশোরের সেই সাক্ষাতের কথা সাংবাদিক ইসাক জানতেই পারেন, কানে–‌শোনা হতে পারে না, অসম্ভব। ঘটনাটা বুঝে এই সংলাপ তাই ইসাকের ‘‌কার্ডাসীয়’‌ রচনা। পিচের ওপর দুই ব্যাটসম্যানের বাক্যালাপ যেভাবে ‘‌লিপিবদ্ধ’‌ করতেন ক্রিকেটলেখায় কিংবদন্তি নেভিল কার্ডাস। হিন্দি ছায়াছবির সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে থাকার কারণে ইসাকের লেখাতেও তখনকার সিনেমার প্রত্যক্ষ প্রভাবে এমন শেষইচ্ছেয় মধুবালার সিঁথিতে সিঁদুর। আর, সেই কারণেই, আরও একটু এগিয়ে (‌বা পিছিয়ে!‌)‌ ‘‌এক চুটকি সিন্দুর’–‌এর কৃতিত্বও তা হলে কেন দেওয়া যাবে না মুমতাজ ওরফে মধুবালাকে‍‌!‌

৫৫৬–‌পাতার বইয়ের পাতায় পাতায় এমন ‘‌এক চুটকি সিন্দুর’। লিখে রাখতে শুরু করলে শেষে লেখার খাতাটাও বইয়ের কাছাকাছি মাপে পৌঁছে যায়!‌ অনিরুদ্ধ ভট্টাচার্য এবং বালাজি ভিট্টল কয়েক বছর আগে ‘‌আরডি বর্মন:‌ দ্য ম্যান, দ্য মিউজিক’‌ লিখে রাষ্ট্রপতি পুরস্কারের স্বর্ণকমল পেয়েছিলেন। পার্থিবের সঙ্গে জুটিতে এবার কিশোরকে নিয়ে লিখে আবারও রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পুরস্কার পেলে অবাক হবেন না যেন।

রাষ্ট্রীয় সম্মান কিশোরের জোটেনি। উল্টে দেশজুড়ে ‘‌জরুরি অবস্থা’‌র সময় ইন্দিরা গান্ধীর পুত্র সঞ্জয়ের কারণে তাঁকে সর্বভারতীয় বেতার সংস্থা এবং দূরদর্শন থেকে নির্বাসিত করা হয়েছিল। এমনও হয়েছিল, দ্বৈতগানে কিশোরের অংশ নীরব করে অন্য গায়ক বা গায়িকার গলায় শোনা যেত বাকি গান। সেই ইতিহাসেরও তথ্যনিষ্ঠ বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন অনিরুদ্ধ–‌পার্থিব। 

তাই, এই বই রাষ্ট্রীয় সম্মান পেলে কিশোরভক্তরা আনন্দে গলা ছেড়ে আবারও গাইবেন, ‘‌জানি না, কেন যে, বাজে সে সুর বুকে’‌!


***

গান গেয়েছেন অনেক বেশি ছবিতে। সঙ্গে, ৮৯টি হিন্দি ছবিতে কাজ করেছিলেন অভিনেতা কিশোর। বাংলার চারটি (‌লুকোচুরি, মধ্যরাতের তারা, একটুকু ছোঁয়া লাগে এবং দুষ্টু প্রজাপতি)‌ মিলিয়ে মোট ৯৩ ছবিতে পর্দায় দেখা গিয়েছে তাঁকে, জানিয়েছে ‘বৈশাখী’‌–‌র কিশোরকুমার বিশেষ সংখ্যা, যেখানে সম্পাদক ধ্রুবজ্যোতি মণ্ডলের সঙ্গে অতিথি সম্পাদক হিসাবে কাজ করেছেন দুই কিশোর–‌অনুরাগী জ্যোতিপ্রকাশ মিত্র ও সঞ্জয় সেনগুপ্ত। ৪২ আধুনিক, ১৪৮ সিনেমার গান মিলিয়ে মোট ১৯০ বাংলা গান ও ২৪ রবীন্দ্র সঙ্গীতের দুটি অ্যালবাম। প্রতিটি গানের রেকর্ডের নম্বর ও তারিখসহ।

নায়ক–‌গায়কের ৩৫তম প্রয়াণ বর্ষে বেরনো ২৯২ পাতার এই বই আসলে সংকলন। কিশোরকুমার সম্পর্কে বিদগ্ধদের মতামত। আর রয়েছে কিশোরভক্তরা যা খুঁজে বেড়ান রোজ। লতা মঙ্গেশকারের নেওয়া কিশোরের সাক্ষাৎকার, প্রীতীশ নন্দীর নেওয়া ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকার, লতা–‌আশা কী বলতেন কিশোর সম্পর্কে, সলিল চৌধুরি, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং অবশ্যই সত্যজিৎ রায়ও। সঙ্গে গায়ক, সুরকার ও পরিচালকদের কথা, বাংলায় মুকুল দত্ত ও কিশোরকুমারের সম্পর্কের কথা। বহু গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ দু–‌মলাটে। সেরা হিন্দি সোলো এবং লতা–‌আশা ছাড়াও হিন্দিতে আরও যাঁদের সঙ্গে দ্বৈতগান গেয়েছিলেন, সংক্ষিপ্ত তালিকা। ৩০০ টাকায় দুর্দান্ত সংগ্রহ!‌

অতিথি সম্পাদকদের কাছে ছোট্ট অনুযোগ তবুও। ফিল্মফেয়ার পত্রিকা ১৯৫৬ সালে কিশোরকুমারের অভিনব সাক্ষাৎকার ছেপেছিল। ফিল্মজগতে তখনকার ‘তারকা’ কিশোরকুমারের সেই সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন ‘কিশোর গাঙ্গুলি’ নামের কমবয়সি তরুণ। হ্যাঁ, কিশোরকুমারের নেওয়া কিশোরকুমারেরই সাক্ষাৎকার! স্থান-কাল-পাত্র বলে শুরু হওয়া সেই লেখা আসলে তাঁর ‘অল্টার ইগো’-র সঙ্গে ‘স্টার’ কিশোরকুমারের মনখুলে কথা। গত ৬৯ বছরে, এমন ভাবতেই পারেননি আর কেউ। আসলে, কিশোরকুমার একবার ভেবে ফেলার পর কেউ কেউ এমন ভাবতে চাইলেও সামনে দাঁড়িয়ে পড়তেন সেই কিশোরই। তাঁর গান ‘কপি’ তো হয়েছেই, তাঁর ভাবনাও টুকব, ভেবেই হয়ত নিজেকে নিরস্ত করেছিলেন ‘বিখ্যাত’ কেউ। তাই কিশোর থেকে গিয়েছেন অদ্বিতীয়। এই সংকলনে সেই সাক্ষাৎকারটাও থাকলে পূর্ণ হত ষোলকলা।


●‌ ‘‌কিশোরকুমার:‌ দ্য আল্টিমেট বায়োগ্রাফি’, অনিরুদ্ধ ভট্টাচার্য–‌পার্থিব ধর, হার্পার কলিন্স, ৬৯৯ টাকা

●‌ বৈশাখী, ‌কিশোরকুমার বিশেষ সংখ্যা‌, সম্পাদক ধ্রুবজ্যোতি মণ্ডলের সঙ্গে অতিথি সম্পাদক  জ্যোতিপ্রকাশ মিত্র ও সঞ্জয় সেনগুপ্ত, ৩০০ টাকা‌‌‌‌

* আজকাল রবিবাসর, ৩০ জুলাই ২০২৩ প্রকাশিত

Saturday, July 17, 2021

কাশীনাথ ভট্টাচার্য / কচুরি নিয়ে জলকচুরি!

সব দোষ পলাশের। ব্যাটা মোহনবাগানি!

ক্যারাম খেলার প্রতি আমার দুর্বলতা সুবিদিত। আর পলাশটা রোজ শোনায়, সালকে-তে ওর পাড়ার ক্লাবে নিয়মিত ক্যারাম পেটানোর কথা। স্টেট ব্যাঙ্কের চাকরি সেরে সোজা ক্লাবে গিয়ে খেলে-টেলে বাড়ি ফেরে। রবিবার তো সারাদিনই, শনিবারও ছুটি থাকলে সকাল-বিকেল-সন্ধে। প্রচুর হিংসে আমার!
বললাম তাই, একটা রোববার সকাল-সকাল তোর বাড়ি যাব, সারাদিন ক্যারাম খেলে আর দুপুরে তোর বাড়ি মাংস-ভাত খেয়ে ফিরব। 'যে দিন বলবি, চলে আয়। খেতে তো আর পারবি না, এত গেম খাবি!'
হেব্বি রাগ হল, সত্যিই। ক্যারাম নিয়ে আমাকে কথা শোনানো! না হয় ৪-৫ বছর হাত দিইনি, না হয় নিয়মিত খেলা ছেড়েছি বছর কুড়ি, কিন্তু তাই বলে পলাশের বাতেলা শুনব? বলে কিনা, দশের কম কোনও বোর্ডে ও পেলেই নাকি গেম আমার। সাহস!
জেগে উঠল পৌরুষ, এই ছুঁই-ছুঁই পঞ্চাশে। সামনের রোববারই যাব, চল দেখি!
ব্যস, বাবু অমনি হোয়াটস্যাপ জগতের বাইরে! মঙ্গলবার এল আবার, দিন পাঁচ পর। মনে করাতে বলে ব্যাটা, 'তুই বলেছিলি নাকি? ঢপ, দেখিইনি।' বন্ধুরা গাল পাড়ল ওকে, গুছিয়ে। বুঝলাম, যা বোঝার!
বাগুইআটিতে অনন্য থাকে। কলেজে আমার বছর দুই জুনিয়র। খবর দিল, ওর বাড়িতে একটা ছোট বোর্ড আছে। হইহই, চল চল। ওর ছেলের পরীক্ষা চলছিল। সপ্তাহ তিন অপেক্ষা। অবশেষে এক সন্ধ্যায় ক্যারাম। বাপ্পা এল। পরে ওর মেয়ে-বউ। সোনালি, ছেলেকে নিয়ে। অনন্যর ছেলে এবং তার বন্ধু তো ছিলই। অনন্যর বউও দেখলাম ফাটিয়ে খেলে। একটা-একটা ঘুটি, নিখুঁত। আমার ছোটবেলায় মা-কেও খেলতে দেখেছিলাম, অবিকল ওভাবে। বললামও। সোনালি চমৎকার রান্না করে এনেছিল। গুছিয়ে ক্যারাম, গান, খাওয়া --- আহা!
ইউরোপে ক্লাব-মরসুম চলাকালীন আমার রাত-জাগা বেড়ে যায়। সকালে হাঁটা একবার বন্ধ হলেই হল, জানুয়ারির পর মাস তিনেক একদম হয় না। এবার আর শুরুই হচ্ছিল না। প্রস্তাব দিলাম বাপ্পা আর অনন্যকে, চল, হাঁটি। ওরা রাজি। সোমবারটা বাদ দিয়ে মঙ্গল থেকে, সকাল সোয়া ছ'টায় জোড়ামন্দির। দু'সপ্তাহ পর বাপ্পার মেয়ের স্কুল খুলল, আমরা ছ'টায় জোড়ামন্দির। মাস দুই হতে চলল, হইহই করে হাঁটছি। শুধু, সোমবার অফডে। সপ্তাহে ছ'দিন। মন-শরীর ফুরফুরে। সুগারের কাঁটা ১২২ পেরচ্ছে না!
দেবমিত্রা, মানে অনন্যর বউ, অবশ্য সেই দিনই সাবধান করেছিল, 'তোমার সঙ্গে দুটোই কিন্তু ফুডি। ভাল খাবারের সন্ধান পেলেই হাঁটা ছেড়ে দৌড়বে।' হলও তাই। আমার আবার কচুরির টান! চ', রোববার করে কচুরি-সংঘ। বলামাত্রই প্রস্তাব-পাস ধ্বনি-ভোটে!
আমরা এখন রোববার হাঁটার পালা শেষ করে, বাপ্পার গাড়িতে চেপে কচুরি সাঁটাতে বেরচ্ছি! এই রোববার গেলাম পুঁটিরাম, কলেজ স্ট্রিট। বাগুইআটি থেকে কলেজ স্ট্রিট গিয়ে কচুরি, লোকজন বলছে ঢাকের দায়ে মনসা বিক্রি। আমাদের বয়েই গ্যালো!
বয়সে একশো পেরিয়ে-যাওয়া দোকানে সাতসকালে গরম কচুরি আর খোসাসহ আলুর তরকারি, সঙ্গে আবার গরম জিলিপিও, যা 'জলেবি' কখনও নয় --- আহা রে, অমৃত! এমন কচুরি-জিলিপির জন্য আরও ছ'দিন গড়ে চার কিলোমিটার করে হাঁটা তো তুচ্ছাতিতুচ্ছ!
সামনের রোববার আমহার্স্ট স্ট্রিটে গীতিকা না নাগেরবাজারে অভিরুচি? অনন্য-বাপ্পা ঠিক করছে, আমি আপাতত পোস্টাচ্ছি!
আর হ্যাঁ, পলাশ, থ্যাঙ্কু। তুই ওভাবে ক্যারাম খেলাটা বাইপাস না করলে আমি অনন্যকে খুঁজতাম না, একসন্ধে ক্যারাম খেলতে গিয়ে, আমাদের রোজকার হাঁটা আর রোববারের কচুরি-সংঘও পথ-চলা শুরু করত না।
আসলে, মোহনবাগান তো, বিপক্ষকে ভাল খেলতে চুংচুং-শসা- অমলেট বলে ফেলে বাড়তি উৎসাহটা দিয়েই ফেলে!
বিঃ দ্রঃ আমার সঙ্গী দুই হাঁটুরে, বাপ্পা আর অনন্যও, তীব্র মোহনবাগান!!


                                                                                                                            

















                                    ** ১৭ জুলাই ২০১৯

Wednesday, July 14, 2021

কাশীনাথ ভট্টাচার্য / সেন্ট পিটার্সবার্গের পাভলভ আকাদেমিতে এক সকালে...

একটি কুকুর। পিকলস নয়, লাইকাও নয়। শুধুই একটি কুকুর। শুধু একটি কুকুরও নয়। কুকুর জাতি। তাদের সম্মানে।

ছবির এই কুকুর আমাদের অতি পরিচিত। তবে, চিনিয়ে দিতে হয়। বললেই খেলা শেষ। তবু,বলা উচিত।

তার বেদিতে লেখা, সেই সব কুকুরের সম্মানে, বিজ্ঞানের গবেষণা-বেদিতে মানবজাতির উন্নতির স্বার্থে যাদের নিঃস্বার্থ বলিদান। সঙ্গে আরও বেশ কয়েকটি কুকুর, সেই গোল বেদির চারপাশে।
সবার ওপরে যে, কোনও নাম নেই। পরিচিতি ‘পাভলভ ডগ’। এবার চিনেছেন নিশ্চয়। ক্লাস নাইনের জীবন বিজ্ঞান বই, প্রতিবর্ত ক্রিয়ার মতো খটোমটো নাম। ঠিক রাত ন’টায় কুকুরকে খাবার দিতে এলে কুকুরের লালা ঝরতে শুরু করে ন’টার ঘন্টা পড়লেই ইত্যাদি যা আমাদের কুণ্ডু-দাশ-কুণ্ডুতে পড়ানো হয়েছিল। রাত ন’টা এখানে রূপক। সন্ধে সাতটা হোক বা দুপুর একটা, একই ব্যাপার। ইভান পাভলভের আবিষ্কার। শর্তসাপেক্ষ বা শর্ত ব্যতিরেকে প্রতিবর্ত ক্রিয়া। একই লোক রোজ একই সময় এলে এবং সেই সময় ঘণ্টা বাজলে, একই কুকুরের মুখ দিয়ে লালা ঝরবে। কোনও দিন ঘণ্টা বাজল না হয়ত, বা লোক পাল্টে গেল, কিংবা খাবারের পাত্র ছাড়াই এল অন্য লোক। কোন্ কোন্ শর্ত কেমনভাবে প্রভাব ফেলবে – এমন সব গুরুগম্ভীর বিষয়। সব মাথার ওপর দিয়ে যায় বলেই তো জীবন বিজ্ঞানটা আমার আর হল না। অবশ্য কোনওটা যে হয়েছে, এমন দাবিও নেই!
কিন্তু দেখে ভাল লাগে, কুকুরের জন্যও বেদি নির্মিত এখানে, পাভলভ আকাদেমিতে। সেন্ট পিটার্সবার্গে সেমিফাইনাল দেখতে আসার পর ফুরসত খুঁজছিলাম। সেমিফাইনালের সকালে পেলাম সুযোগ। যেখানে ছিলাম, খুব বেশি দূর নয়। বিজ্ঞানীর গবেষণাগারও ‘আকাদেমি’, মনে রাখবেন প্লিজ! নতুন বিজ্ঞানী গড়ে তোলা হবে যেখানে।
উলিতসা আকাদেমিকা পাভলোভা নামক এই বিজ্ঞানী প্রস্তুতকারক বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার মুখেই বাধা। বড় গেট। ভেতরে দ্বাররক্ষী, হাতে ট্যাব নিয়ে বেরলেন দেখে ট্যারাচোখ আমার! রুশ ভাষায় পরিষ্কার বুঝিয়ে দিলেন (!), আমরা বুঝলামও যে,তিনি স্বার্থপর দৈত্যের ভূমিকায়, আমাদের প্রবেশ নিষেধ সেই সুন্দর বাগানে। কাকুতি-মিনতি চলল। সেই সুদূর ভারত থেকে এসেছি, কুকুরের বেদি না দেখেই চলে যাব? টিকিট কাটতেও রাজি, কোথায় পাব? মন গলে না কিছুতেই। ইংরেজি এক্স অক্ষরের মতো দুহাত নড়ছে শুধু, ডানহাতে ধরা ট্যাবটা তখনও!
অগত্যা? বাঙালিসুলভ বাউন্ডারির চারপাশে ঘুরে বেড়ানো। যদি ফাঁক দিয়ে দেখা যায়। যা দেখা গেল তাতে ছবি হয় না। চেষ্টা করেও নয়, ক্যামেরা দুরন্ত হলে, ৫০ মিটার দূরের ছবি জুম করে তোলার মতো হলেও, নয়। গাছপালা এত, অযত্নলালিত না সযতনে এমন অযাচিত ভাবে গজিয়ে তোলার চেষ্টা, বিজ্ঞানীরা বলবেন। ব্যর্থ মনোরথ। গুটি গুটি পায়ে আবারও সেই গেটের সামনে। এত কাছে এসেও এভাবে ফিরে যাওয়া, মানতে না পেরে।
গটগটিয়ে বেরিয়ে এলেন এক তরুণ। প্রায় কান্নাকাটি করে ফেলি আর কী! আপনি একবার যদি, বুঝিয়ে-সুজিয়ে... তাঁর অস্বস্তি বাড়ছে ক্রমশ। পরিচয়পত্র দেখালেন, তিনি ছাত্তর। সদ্য পড়াশোনা শেষ করে বেরিয়েছেন। ‘তা’লে আর কী, আপনার বন্ধুই তো আমরা, কথা দিচ্ছি, একটা ছবি তুলেই বেরিয়ে আসব, প্লিজ ...’ শুনতে শুনতেই গাল প্রায় লাল সে ছাত্তরের। এত বড় অন্যায়টা পাভলভের সঙ্গে, তাঁর আজন্মলালিত ‘ডিসিপ্লিন’-এর সঙ্গে, শুধু এক বিদেশির খাতিরে কি, দ্বিচারিতা... দ্বিধায় ...
তারপর যা হল, ছবিতে ...
এই চিত্রনাট্য যাঁর সাহায্য ছাড়া লেখাই হত না ... Prasanta Das 🙂

* ১৫ জুলাই ২০১৮

Friday, July 9, 2021

কাশীনাথ ভট্টাচার্য / ফাভেলার সিঁড়ি বেয়ে ওঠার রোমাঞ্চ আর ‘এলিপোন্তো’-র ঘোলেই ‘রিডিমার’ দুধের স্বাদ

‘‘গোল বলের পেছনে ছুটতে ছুটতে আমরা কি ক্রমশ ছাগোল হয়ে পড়ছি না রে কাশী?’’ 

প্রশ্নকর্তা বাবু সৌম্যজিৎ বসু, টাইমস অফ ইনডিয়ার ফুটবললিখিয়ে। বিশ্বকাপ শুরুর দিন দশেক পর ব্রাজিল পৌঁছেছিলেন নিজের কিছু কাজে আটকে গিয়ে। তখন এটাই ক্রমশ নিয়ম। রোজই বেশ ভেবেচিন্তে কিছু একটা বলে সৌম্যজিৎ আর আমরা হইহই করে ওকে থামিয়ে দিয়ে নিজের নিজের কথা বলতে শুরু করি, মিটিং যায় ভেস্তে!

চারজনের দুর্দান্ত গ্রুপ গড়ে উঠেছে। সৌম্যজিৎ, শুভ্র, উমেদ আর আমি। শুভ্র সারাদিন-সারারাত লিখেই চলেছে, শেষ নেই। যতবারই জানতে চাই, বলে, ‘না গো, এই স্টোরিটা লিখে দিতেই হবে।’ কী স্টোরি, কোথায় পাচ্ছে, কেল লিখছে --- আমাদের কাজের জীবন রীতিমতো সংশয়ে! একই জায়গা থেকে একটা ছেলে স্টোরির পর স্টোরি দিয়ে যাচ্ছে আর আমরা ভ্যারেন্ডা ভাজছি, একেবারে আক্ষরিক অর্থে। উমেদ আর সৌম্যজিৎ চটপট লেখা শেষ করত। আমি একটু সময় নিতাম, তবে শুভ্রর মতো নয়! তারপর দিনের খেলাশেষে বা বেলাশেষে ছোটখাটো মিটিং, আগামিকাল কোথায় যাব, কী কী করব ইত্যাদি। তখনই সেই ছাগল-জিজ্ঞাসা সৌম্যজিতের।

কারণটা খোলসা করেই বলা যাক। দিনটা ২ জুলাই ২০১৪। আমরা রিও-তে। দু’দিন পর ফ্রান্স-জার্মানি কোয়ার্টার ফাইনাল মারাকানায়। সাও পাওলোয় ১ জুলাই আর্জেন্তিনা-সুইৎজারল্যান্ড ম্যাচ করে গভীর রাতের বাস ধরে দুপুর-দুপুর পৌঁছে গিয়েছি রিও-তে। অভ্যাসমতো মারাকানা ঘুরে হোটেলের পথে যেতে যেতেই আলোচনা চলছে, ফিফার বাসে। উমেদ নেমে যাবে ওর হোটেলে, আমরা চলে আসব আমাদের আইবিস-এ।
সৌম্যজিতের বলার উদ্দেশ্য, প্রতিযোগিতা শেষ হতে চলেছে, আমরা তত দিনে বার তিনেক রিও চলে এসেছি, আবার ওখান থেকে অন্য শহরে চলেও গিয়েছি। বাবু বলছিলেন সখেদ, ‘একটা বেলাও কি আমরা এই সব মারাকানা-ফারাকানা ছেড়ে একটু শহরটা ঘুরে দেখতে যেতে পারি না? এতই কাজ আমাদের! রিও এসে ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার দেখব না, কোপাকাবানা বিচে গিয়ে শুয়ে থাকব না – বাড়ি ফিরে পাড়াপড়শিকে তো মুখ দেখানোর সুযোগটাও দিলি না রে কাশী!’ 

ঘটনা, যাকে বলে, নির্জলা সত্যি! কোপাকাবানা বিচের পাশ দিয়ে ফিফার বাস নিয়ে যেত, ওই বাস থেকেই জানলার পর্দা সরিয়ে দেখা যতটুকু। ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার দেখা যায় মারাকানা স্টেডিয়াম থেকে, ব্যস্। কাজের শেষ নেই, লিখে ফাটিয়ে দিচ্ছি সবাই, ক্রীড়া সাংবাদিকতার ইতিহাসে আমাদের সেই সব প্রতিবেদন অমরত্ব দাবি করছে মনে করে আমাদের হাঁটাচলাই পাল্টে গিয়েছে প্রায়! আসলে যে কোথায় কে কী বলছে আর ম্যাচ রিপোর্ট-এর বাইরে যেতেই পারছি না, ভাবার সময়ও নেই। বিশ্বকাপ, তাই না!

সেই দিন কিন্তু আমরা একমত হলাম, এটা সত্যিই বাড়াবাড়ি। এবং, পরের দিন যেহেতু বিকেল চারটের আগে ফ্রান্স এবং জার্মানির প্রেস কনফারেন্স নেই, তিনটে পর্যন্ত আমাদের হাতে ফাঁকা সময়। শুভ্র, যথারীতি, লেখার কথা বলেছিল। থামিয়ে দিই হইহই করে। ব্রাজিলের চেযে ভারত সাড়ে আট ঘণ্টা এগিয়ে। আমাদের সবাইকেই ব্রাজিলীয় সময় দুপুর একটা-দেড়টার মধ্যে লেখা পাঠিয়ে দিতে হত। ম্যাচ ধরানোর প্রশ্নই থাকত না। তাই ম্যাচের পরের কপিগুলো রেখে দেওয়া হত পরের দিন ঠিক সময়ে পাঠানো হবে বলে। সেই রাতে বা পরের সকালে লিখে ফেলে বেরিয়ে পড়তাম পরের দিনের খাবার, থুড়ি, খবরের সন্ধানে। তাই ঠিক করে নেওয়া হল, সেই রাতেই পরের দিন সকালে যা যা পাঠানোর, পাঠিয়ে রাখতে হবে। আমরা ঘুরতে বেরব!

হোটেলের ডেস্ক-এ কথা বলে পাওয়া গেল এক চালকের মোবাইল নম্বর। এমন চালক যিনি ইংরেজি জানেন। একটা গোটা বেলা ঘুরে বেড়াব আর চালকের সঙ্গে কোনও কথা হবে না আকার-ইঙ্গিত ছাড়া – হয় নাকি? পাওয়া মুশকিল, তবু, জানা গেল, একজন আছেন। তাঁর মোবাইল নম্বর পেলাম। কথা বলে নেওয়া হল। সকাল সাতটায় চলে আসবেন তিনি। আমরা রেডি হয়ে থাকি যেন। শহরের দ্রষ্টব্য স্থানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখাবেন। আমরা মহাখুশি।

সকালে যথারীতি তিনটে বাঙালি আধঘণ্টা দেরি করল। ওদিকে ‘হোটেল নিসে’ থেকে উমেদ ফোন করেই চলেছে, আর আমাদের ঘরে-ঘরে ‘এই তো, বেরচ্ছি’ চলছে। কোনও রকমে বেরিয়ে এসেই চালক কার্লোসের ধমক, ‘এত দেরি করলে চলবে? ও দিকে যে লাইন পড়ে গ্যালো!’ কীসের লাইন, শুনি গাড়িতে উঠে। উমেদকেও তুলে নেওয়া হল। ততক্ষণে জেনে গিয়েছি ‘মুক্তিদাতা’ যিশুর মূর্তির কাছাকাছি যাওয়া হয়ত হবে না। কার্লোস নাকি আসার সময়ই দেখে এসেছে বিরাট ভিড়। আর আমাদের সবারই ইচ্ছে, রিও-র সেই বিপজ্জনক ‘ফাভেলা’ দেখার। এত গল্প শুনেছি, গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো। একবার তো যেতেই হবে। আর আজই সেই সময়। সুতরাং, প্রথমে যাওয়া যাক তেমন কোনও একটা বিপজ্জনক বস্তি দেখতে।

রিও-র এই বস্তি অঞ্চলগুলো অপরাধের স্বর্গরাজ্য বলে কথিতই শুধু নয়, হাড়ে হাড়ে সত্যিও। ড্রাগস-এর আঁতুড়ঘর, ছুরি-টুরি নয়, গোলাগুলি চলে অহরহ। কাউকে পছন্দ না হলেই, ব্যস! ব্রাজিল যাওয়ার আগে যা যা পড়া এবং দেখা ছিল ‘মাস্ট’, একটি সিনেমাও ছিল। ‘সিদাদে দে দেউস’, ইংরেজিতে ‘সিটি অফ গড’। অমন আর দেখা হয়নি বিশেষ। বস্তির বাচ্চারা এবং বড়রাও অবশ্যই, কী অনায়াসেই না মানুষ মেরে ফেলেন ইত্যাদি নিয়ে। সত্যি ঘটনা অবলম্বনে তৈরি সিনেমা বিশ্বজোড়া খ্যাতি পেয়েছিল। আমাদের চালক কার্লোসকে অত বলতেও হয়নি। তিনি জানালেন, তুলনায় কম বিপজ্জনক ফাভেলাও আছে। কোনও একটিতে নিয়ে যাবেন যা কাছাকাছি এবং অবশ্যই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসা যাবে। টেনশন যা-ই হোক না কেন, আমরা তৈরি!

গাড়ি চলছে, আমরা গপ্পোগুজব করছি। হঠাৎ একটি জায়গায় কার্লোস গাড়ি থামিয়ে দিলেন রাস্তার ধারে। আর বলে ফেললেন, ‘প্রত্যেকের ক্যামেরা, মোবাইল, ল্যাপটপের ব্যাগ, মানি ব্যাগ বের করে আমাকে দিন।’ আমরা প্রথমটায় অবাকই হয়েছিলাম। কার্লোস বুঝতে পেরে শুধরে নেন নিজেকে। ‘আমরা কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছি। আপনারা কেউ হাতে বা পকেটে কিছু নিয়ে বেরবেন না। শুধু বুকপকেটে ৩০-৪০ রেয়াইস রেখে দিন। বাকি সব থাকবে আমার গাড়িতে। আমি নীচেই থাকব। যে জায়গাটায় গাড়ি রাখব, সামনেই সিঁড়ি পাবেন। তরতর করে উঠে যাবেন, আবার নেমেও আসবেন। চেষ্টা করবেন যেন কারও সঙ্গে কথা না বলতে হয়। আর কোনওভাবেই উঁচু স্বরে কোনও কথা বলবেন না।’

 
সেই চালকের সঙ্গে শুভ্র আর উমেদ
এবার বুক কাঁপতে শুরু। কে যেন জিজ্ঞেস করেই ফেলল, ‘আচ্ছা ওই বুকপকেটে রেয়াইস কেন রাখতে বললেন?’ জবাব শুনে গা হিম। যদি কেউ ছিনতাই করতে আসে, কিছুই না পেয়ে রেগে গিয়েও তো গুলি চালিয়ে দিতে পারে! এবার আমরা ভাবতে শুরু করি, যাওয়া কি উচিত হবে? কার্লোস আবার অভয় দেন, ‘না না, নর্মালি গিয়ে চলে এলে বিশেষ কিছু হয় না। সাবধানে যান, চটপট দেখে ফিরে আসুন।’ আশ্বাস পেয়ে খানিকটা সাহস সঞ্চিত হল কিনা বলতে পারছি না, তবে, চটপট নিজেদের সব কিছু কার্লোসের গাড়িতে জমা করে ফেলি। কার্লোস আবার সেই সব রেখে দেন সিটের তলায়, হঠাৎ তাকালে যাতে নজরে না পড়ে। খানিকটা গিয়ে তারপর থেমে গেল গাড়ি। সামনে একটা চওড়া সিঁড়ি। অনেকটা উঁচুতে উঠে গিয়েছে। কোথাও কোনও জনমানুষের চিহ্ন নেই। চালকসাহেব বলে দিলেন, ‘মিনিট দশেক সময় দিলাম, যান চট করে ঘুরে আসুন। পাঁচ-ছ’মিনিট উঠবেন ঘড়ি দেখে, ফিরে আসবেন। বেশিক্ষণ দাঁড়ালে আমারও বিপদ।’ 

কী দেখব, কীসের সামনে পড়তে হবে কিছুই জানি না, তবু মানুষের কিছু অদ্ভুত কৌতূহল থাকে। আজ সেই দিনের কথা লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে, আমরা ওখানে কেন গিয়েছিলাম? কীসের সন্ধানে? আমরা কি চেয়েছিলাম, কেউ এসে আমাদের ভয় দেখাক? মানে ঠিক কোন্ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে চেয়ে আমাদের সেই অভিযান? যেচে বিপদ ডেকে আনার কি কোনও মানে হয়? কিন্তু সেই সকালে তুমুল ভয়ের পাশাপাশি ইচ্ছেটাও ছিল যে, একবার অন্তত পরিবেশটা দেখে আসি। সেটাও অস্বীকার করতে পারিনি অন্তত সেই দিন। তাই ‘মুক্তিদাতা’-কে ছেড়ে দিয়ে আমরা ফাভেলা-সন্ধানী।

গাড়ি থেকে নেমে চারজনই পরস্পেরর দিকে তাকাই। উঠতে শুরু করি সেই সিঁড়িগুলো বেয়ে। কয়েকটা সিঁড়ি যেতেই দু’দিকে বাঁক, গলির মতো, ভেতরে। অজস্র ঘর, টিপিক্যাল বস্তি। যদিও সেই সিঁড়ি বা যতটুকু চোখ যাচ্ছিল, নোংরা বা আবর্জনা দেখিনি, এমনক চ্যাঁচামেচিও শুনিনি। হঠাৎ একটা বাঁক থেকে বেরিয়ে এলেন এক হিপি। মদের গন্ধে ম ম করছে। আমাদের দেখলেন, আমরা চোখ সরিয়ে নিতে গিয়েও পারলাম না। কিন্তু কিছু বললেন না, টলমল করতে করতে হাতের সিগারেটে টান। গন্ধে মনে হল গাঁজা। চোখাচোখি, সৌম্যজিৎ ঘাড় নাড়ল, শুভ্রও। উমেদ কিছু না বলেই উঠে চলেছে, আমরাও পেছন পেছন। দাঁড়ানো চলবে না যে!
আমরা চারমূর্তি!
৬০-৭০টা সিঁড়ি উঠেছিলাম। অপ্রীতিকর কোনও দৃশ্য বা ঘটনার মুখোমুখি হইনি। একজায়গায় দুজন কমবয়সিকে প্রেম করতে দেখেছিলাম ঘন হয়ে, ওটুকুই। আমাদের পাত্তা দেয়নি, আমরাও না। একটা নির্দিষ্ট জায়গা পর্যন্ত গিয়েই অ্যাবাউট টার্ন। নামার গতি বোধহয় আরও বেশি। নির্ধারিত ওই মিনিট পনের-র মধ্যেই সোজা এসে গাড়িতে এবং শঙ্কর মহাদেবন তাঁর সেই বিখ্যাত ‘ব্রেথলেস’ গানের শেষে যেমন বেশ জোরে শ্বাস ছাড়েন একবার, আমরা চারজনই গাড়িতে সেঁধিয়ে বোধহয় তার চেয়েও জোরে ছাড়লাম, শব্দ করেই। কার্লোসের গাড়ির ইঞ্জিন আমাদের নামতে দেখেই তৈরি ছিল। আমরা চারজন উঠে পড়তেই এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে বেরিয়ে পড়ল। একটু স্বাভাবিক হয়ে আমাদের কারও একজনের বোধহয় মনে পড়েছিল যে, এমন একটা জায়গার কোনও ছবি তোলা হল না? চালকই প্রায় মারতে আসেন শুনে!

‘আপনাদের সবই তো আমার গাড়িতে ছিল, ছবিটা তুলবেন কী করে? আর, ছবি তুলতে গিয়ে ক্যামেরাটা চলে গেলে দায়িত্বটা কার? আপনাদের নিয়ে এসেছি আমি, পরে তো আমাকেই গালাগাল করতেন, তাই না?’ 

মানুষের ভালবাসা বড় ছোঁয়াচে! বিশ্বকাপের সময় ব্রাজিল জুড়ে অপরাধের মাত্রা কমেছিল, সত্যি যেমন, এই মানুষগুলোও, রাস্তায় যাঁরা আমাদের সঙ্গে চলতেন, সেই কাজে সাহায্য করেছিলেন প্রচুর। বিপদের সম্ভাবনা আঁচ করলে নিজেরাও দাঁড়িয়ে পড়তেন বা সঙ্গ দিতেন, পাহারা দিতেন এমনভাবে, প্রথমে ভয় পেতাম, পরে বুঝতে পারতাম যে, ওঁরা সাহায্যই করছেন। মনে আছে, রিওতে আইবিস থেকে বেরিয়ে খেতে যেতাম যে রাস্তায়, মাঝে একটা বেশ বড় মাঠ ছিল। দিনের বেলা কিছু মনে হয়নি। রাতে ওই ন’টা নাগাদ বেরিয়ে মনে হয়েছিল আধো আলোছায়ায় ওই মাঠটা পেরিয়ে যাওয়াটা উচিত হবে কি? একটু দাঁড়ালাম। আধো আলোয় চোখ সইয়ে নিয়ে দেখি কিছু মানুষ হাঁটছেন। আমরা একটু জোরে হেঁটেই ওদের পিছু নিলাম যখন, ওদের গতি কমে গেল! এগোলাম না কাছে। দূরে দেখতে পেলাম একটা গাড়ি কোণাকুণি দাঁড়িয়ে, সামনে দুজন পুলিশ, স্বস্তি। আমরা সেই মানুষগুলোর পেছন পেছন এলাম, একটু দূরত্ব রেখে। ওরাও কিছুই বলেননি। মাঠ শেষ হতেই আমরা খবারের রাস্তায় ঢুকছি যখন, ওরা নিজেদের রাস্তায় চলে গেলেন। এমন বেশ কয়েকবার হয়েছিল। একটুও ভয় লাগেনি তারপর আরও রাত করে খেতে বেরিয়েও।

যাক, আমাদের সেই অভিযানে ফিরি। এবার তো তা হলে ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার? চালকসাহেব জানালেন, অবশ্যই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, এগোলাম। নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দেখি, লাইনের দৈর্ঘ্য মোটামুটি তিন-চার মাইল হবে! পাহাড় থেকে নীচে নেমে এসেছে। অভিজ্ঞ কার্লোস সরাসরি জানালেন, সেই দিন বোধহয় কাকভোর থেকেই লাইন পড়েছিল। না হলে এমন হয় না। এই লাইনে দাঁড়ালে বিকেল বা সন্ধেও হয়ে যেতে পারে!
অগত্যা, কী করণীয়? আলোচনা শুরু। নিয়মটা জানা গেল। মূর্তির কাছে যেতে হলে আমাদের এই গাড়িতে করে যাওয়া যাবে না। ওই লাইনে দাঁড়াতে হবে। সরকারি বাস আসবে ওপর থেকে। নিয়ে যাবে। বাসের সবাই ঘুরে ফেললে আবার ওদের নিয়ে ফিরে আসবে আর তুলে নিয়ে যাবে পরের দলকে। বাস আছে বেশ কয়েকটা। তবে, এক-একটা বাস মানে ঘণ্টা দুয়েক তো বটেই, যা ভিড় তাতে নামতেও সময় বেশি লাগবে। সকাল গড়িয়ে তখন দুপুরের পথে, সূর্য নব্বই ডিগ্রিতে। ফিরে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। মনটা খারাপই।
কিন্তু চালক সাহেব আছেন যে! বললেন নিয়ে যাবেন একটু দূর পর্যন্ত, যত দূর গাড়ি যেতে দেয়। হেলিকপ্টার পয়েন্ট বলে একটি জায়গা আছে, যেখান থেকে হেলিকপ্টারে করে উড়ে যিশুর মাথার ওপর দিয়ে ঘুরে নেমে আসা যায়। তবে তা বেশ খরচসাপেক্ষ। আর তার জন্যও বুকিং করতে হবে। আমরা তখন যদ্দূর যাওয়া যায়, ঘুরে তো আসি মনোভাব নিয়ে লাইনে না দাঁড়িয়ে আবার গাড়িতে। মোটামুটি একটা দূরত্ব যাওয়ার পর গাড়ি থামল। কার্লোস নিজেই ক্যামেরাগুলো বের করে দিলেন এবার, মোবাইল, মানিব্যাগ - সব। নিজেও নেমে পড়লেন, আমাদের সঙ্গে, ঘুরিয়ে দেখাবেন বলে। হইহই করে আমরাও। 

ওই তো দেখা যাচ্ছে মুক্তিদাতা যিশু, দাঁড়িয়ে আছেন দু’হাত ছড়িয়ে, বুকে টেনে নিতে! ‘ওই তো’ বললেও সেটা আসলে যথেষ্টই দূর। কিন্তু, আমাদের মতোই বহু মানুষ দেখা গেল, সেই দিন ওখানে পৌঁছনো বৃতে বুঝে ওই ‘এলিপোন্তো’-র ঘোলেই দুধের স্বাদ মেটাতে এসেছেন। আমরাও দাঁড়িয়ে পড়ি ছবি তুলতে। চালকের পরামর্শে ওখানে ছবি তোলার নিয়ম মেনে, দু’হাত ছড়িয়ে। তিনিই ছবি তুলে দিলেন আমাদের। মোবাইলে তাঁর ছবি তুলে তাঁকে পাঠানোও হল। ওখানে দাঁড়িয়েই পাশের সুগোরলোফ মাউন্টেন-এর সুন্দর ছবিগুলো তুলতে তুলতে ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে, আমাদের পরের গন্তব্য কোপাকাবানা।

দূর থেকেই বিদায় জানানো হল যিশুকে। পরে কখনও যদি সম্ভব হয়, ফিরে আসব, মনে মনে ভেবে রেখে। কিন্তু না, পরেও আর যাওয়া হয়নি। ফাইনালের পরের সকালেই রিও ছাড়তে হয়েছিল, ফেরার বিমান সাও পাওলো থেকে সেই রাতেই ছিল বলে। মাঝে চেষ্টাও করতে পারিনি আর কোনও দিন। এখন মনে হয়, বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার পর অন্তত দিন তিন-চারেক থাকাটা অবশ্যই উচিত ছিল। এ জীবনে ব্রাজিল আর কখনও যাওয়া হবে না যখন, ৪১ দিনের জায়গায় ৪৫ দিন হলে কী-ই বা এমন ক্ষতি হত?

বাঙালির ছেলের চিরকালই চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। তাই শ্যামল মিত্র শুনেই দিন কাটায় এখন – যাক্ যা গেছে তা যাক্!

Thursday, July 8, 2021

কাশীনাথ ভট্টাচার্য / খুনের মামলায় অভিযুক্ত আসামীর বাড়িতে রিও-তে , মেসিরা প্র্যাকটিসে, বেঘর আমি লটবহর নিয়ে রাস্তায়…

 কাশীনাথ ভট্টাচার্য

সাও পাওলোর সঙ্গে প্রথম আলাপ রাতের অন্ধকারে। কিছু করার ছিল না, উড়ানের সময় তো আর আমার হাতে নেই। কিন্তু রিও দে জানেইরো শহরটাকেও প্রথম দেখা ভরসন্ধেয়, রাস্তার সমস্যায়।

২০১৪ বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচ ছিল সাও পাওলো-তে। তাই কলকাতা থেকে সরাসরি সাও পাওলোতেই পৌঁছেছিলাম। ব্রাজিল-ক্রোয়েশিয়া ম্যাচ দিয়ে বিশ্বকাপ শুরু। তার আগে চমৎকার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান আরেনা দে সাও পাওলো-য়। এত ভাল উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বিশ্বকাপে তার আগে কখনও (টেলিভিশনে) দেখিনি। ব্রাজিলের জয়ের পর প্রেস বক্সে ঠিক করে নেওয়া হল, পরের দিন সকাল-সকাল আমরা পৌঁছে যাব সাও পাওলোর বাসস্ট্যান্ডে, গন্তব্য রিও। ব্রাজিলে ট্রেনের সুবিধা নেই। হয় উড়ে যাওয়া, নয় বাসে। বারবার উড়ে যাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। বাসই একমাত্র ভরসা তাই। খবর যা নিয়েছিলাম, সাড়ে চারশো কিলোমিটারেরও কম রাস্তা, ঘণ্টা ছয়-সাত লাগে। সকাল-সকাল শুরু করলে বিকেলের আগেই পৌঁছে যাওয়া যাবে।

কিন্তু, হিসেব মেলে না! প্রথমত টিকিট কাটতে গিয়ে প্রচুর সময় গেল। দ্বিতীয়ত, আরও কয়েকজন আসবে, অপেক্ষা করতেই হল। শেষমেশ ন’টা নাগাদ যাত্রা শুরু। তাতেও বিকেল তিনটে-চারটের মধ্যে তো অবশ্যই পৌঁছে যাব, ভেবে সান্ত্বনা। আর আমার এক পূর্বপরিচিত, যিনি কথা দিয়েছিলেন রিও-র বাস স্ট্যান্ডে থাকবেন অপেক্ষায়। নিয়ে যাবেন আমাদের, তাঁর ঠিক করে-রাখা আস্তানায় যেখানে বিশ্বকাপের সময় বিভিন্ন ম্যাচের হিসেবে দিন কুড়ি থাকব আমরা। সুতরাং, ‘চিন্তা’-র কোনও ‘ভাবনা’ নেই!

রাস্তায় মাঝে মাঝেই পাহাড়। অন্তত গোটা ছয়েক তো বটেই। তারই মাঝে এক জায়গায় আটকে যেতে হল। উল্টোদিকের রাস্তায় কিছু একটা হয়েছে বোঝা গেল। কাউকে জিজ্ঞেস করে জানার উপায় নেই। আমাদের সে সব ভাবনাও ছিল না। নিজেরাই ছবি তুলতে তুলতে, গপ্পোগুজব করতে করতে সময় কাটিয়ে দিলাম। ঘণ্টাখানেক গেল ওখানে। তারপর পাহাড়ি রাস্তায় জট ছাড়াতে আরও বেশি সময়। তাই, রিও পৌঁছলাম যখন পড়ন্ত বিকেল এবং জানা গেল, সেই পূর্বপরিচিত ভদ্রলোক তখনও এসে পৌঁছতে পারেননি!

তাঁর পৌঁছনোর অপেক্ষায় আরও আধঘণ্টা মতো। গাড়িতে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছতে পৌঁছতেই জানা গেল বিশ্বচ্যাম্পিয়ন স্পেন প্রথমে এগিয়ে গেলেও নেগারল্যান্ডস ফিরে আসছে, প্রথমার্ধ ১-১। আমরা নেমে পড়লাম একটা ছোট রেস্তোরাঁর সামনে। পেছনেই একটা বিরাট বাড়ি, কততলা বোঝার উপায় নেই। বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে রেস্তোরাঁর সামনে দাঁড়িয়ে পড়লাম খেলাটা দেখব বলে। ‘সেই পূর্বপরিচিত ভদ্রলোক’ কথা বলতে গেলেন সেই বাড়িতে। আমরা অপেক্ষায়।

রিও-র সেই প্রথম আস্তানার ব্যালকনি থেকে দেখা কোপাকাবানা
রবেন-ফন পার্সিরা ওদিকে ছিঁড়ে খেতে শুরু করেছেন বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের। রেস্তোরাঁর স্বচ্ছ কাচের সুবিধে নিয়ে আমাদের চোখ সে দিকেই। খেলা শেষ হতে চলল, সেই লোক আর আসেন না! ফোনেও পাচ্ছি না। ব্রাজিলে আবার ফোন করাটা বেশ জ্বালা। প্রতিটি শহরের আলাদা আলাদা কোড, আমাদের এখানে যেমন ‘এসটিডি’ করার সময় জানতেই হত শহরের কোড, তেমন। মুশকিল হল, মোবাইল আসার পর সে সব আর লাগে না। ভিনরাজ্যের নম্বর হলে সামনে একটা ‘জিরো’ দিলেই ল্যাটা চুকে যায়। ব্রাজিলে মোবাইলেও শহরের কোড নম্বর জুড়তে হয়। নানা ফ্যাচাং!

সেই ভদ্রলোক এলেন খেলা শেষ হওয়ার প্রায় আধঘণ্টা পরে, চিন্তিত মুখে। ঝাঁপিয়ে পড়ি আমরা, কী হয়েছে জানতে। বললেন, যার সঙ্গে কথা বলে রেখেছিলেন, সে নাকি কোথায় পালিয়েছে কোনও বেআইনি কাজে জড়িত থেকে। বেআইনি মানে চুরি-টুরি নয়, শোনা যাচ্ছে খুনের মামলায় যুক্ত! মাথায় বাজ বললেও কম। রিও-র অপরাধ জগত সম্পর্কে বহু পড়েছি, সিনেমাও দেখেছি। কিন্তু আমি যেখানে থাকতে চলেছি সেই জায়গার মালিক যদি সরাসরি খুনের মামলায় অভিযুক্ত আসামী হ’ন, জেনে যাওয়ার পর আর কি সেখানে থাকা উচিত?

কিছু করারও নেই। সেই ভদ্রলোকই একমাত্র ভরসা তখন। তিনি আবার ঢুকে গেলেন সেই বাড়ির ভেতর। আমরা ঠায় বসে আছি। পরের ম্যাচটা শুরু হয়েছিল। মাথায় কিছুই ঢুকছে না। ভাগ্যিস ভারতের সঙ্গে সাড়ে আট ঘণ্টা সময়ের পার্থক্য থাকার সুবিধে, আগের দিনের কপি আগের রাতেই লিখে পাঠানো ছিল। অন্তত অফিসের মুখঝামটা শুনতে হবে না, নিশ্চিন্ত। কিন্তু, এখন থাকব কোথায়?

বোধহয় আটটা নাগাদ তিনি বেরিয়ে এসে জানালেন, দিন দুয়েকের জন্য ব্যবস্থা হয়েছে। আপাতত এখানেই থাকতে হবে, অর্থাৎ সেই বিরাট বাড়িটায়। আগামী পরশু সকালে এসে তিনি নিয়ে যাবেন তাঁর ঠিক করে-রাখা আগের বাড়িতে। আশা করছেন, তার মধ্যে সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে এবং সেই অভিযুক্ত আসামীও ফিরে আসবেন। কেন এমন অদ্ভত আশা তাঁর, জানতে চাইনি আর। মালপত্র নিয়ে ঘরে ঢুকে আগে স্নান, তারপর পেটে কিছু দিতে হবে। ভরাপেটে না হয় ভাবব আবার।

গেটে ঢুকতে গিয়েও বিপত্তি। আবার একজন এলেন তালা খুলতে। আমাদের তখন মানসিক অবস্থা যা, কারও চেহারা দেখেই সুবিধের মনে হচ্ছে না! তবু, উঠে পড়ি লিফটে। খুব সম্ভবত এগার-বারতলা ছিল। সেখানে পৌঁছে নির্দিষ্ট ফ্ল্যাটের সামনে পাওয়া গেল এক ব্রাজিলীয় কৃষ্ণাঙ্গ সুন্দরীকে। হাতে চাবি নিয়ে অপেক্ষায়। দোর খুলে দিলেন। ভেতরে ঢুকে নিমেষেই মন ফুরফুরে। এত গোছানো ঝকঝকে সুন্দর!

বুঝিয়েটুঝিয়ে চলে গেলেন তিনি। পূর্বপরিচিত সেই ভদ্রলোকের দাবি এবার, ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, ডলার দিয়ে দিলেই তিনিও চলে যাবেন। দাবি ছিল ওই কুড়ি দিনের জন্য নির্দিষ্ট টাকার পুরোটাই দিতে হবে। রীতিমতো হাতিবাগান স্টাইলে দরাদরি চলল। কোনও মতে দিন দশেকের ডলার দিয়ে মুক্তি। যাওয়ার আগে তিনি আবার দুটো মনে-রাখার কথা বলেও গেলেন। পরশু সকাল-সকাল যেন তৈরি থাকি মালপত্র গুছিয়ে আর যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাঁদিকে যদি হাঁটতে শুরু করি, রাস্তায় প্রথম ক্রসিং-টা পেলেই ফিরে আসতে হবে। পেরিয়ে সোজা যাওয়া চলবে না। বাঁদিকে যেতে পারি শুধু। এবং, ওই ক্রসিংটা পেরিয়ে সোজা চলে যাওয়ার ভুল যেন না-করি একেবারেই। জানতে চাইলেও ভেঙে বললেন না কিছু। কোথায় এসে পড়লাম রে বাবা, বোঝো ঠ্যালা!

রিও-র রাস্তায় আর্জেন্তিনীয় সমর্থকরা

পর দিন সকালে ঘরসংলগ্ন ব্যালকনিতে যেতেই উচ্ছ্বাসে ভেসে-যাওয়া। ওই দেখা যায় কোপাকাবানার নীল জল! ক্যামেরা নিয়ে সকালেই ব্যালকনিতে। আহা রে, এই জায়গাটা ছেড়ে চলে যেতে হবে এক দিন পর, ভাবলেই খারাপ লাগছে তখন। তবে, কাজে বেরতে হবে, ঐতিহ্যশালী মারাকানায় পৌঁছতে হবে ভেবে নিজেকে শান্ত করে চটপট বেরিয়ে পড়ি। সাবধানবাণী মেনে রাস্তায় নেমে বাঁদিকে যাওয়াই নেই! ডানদিক দিয়ে বড় রাস্তায় এবং নিজেদের গন্তব্যে। সারা দিন কাজ সেরে রাতে আস্তানায় ফিরে গোছগাছ। পরের সকালে বেরনোর প্রস্তুতি।

আর সময়ে ভুল নেই। সকালেই চলে এলেন তিনি। আমরাও তৈরিই ছিলাম। স্নান করার দরকার নেই, নতুন জায়গায় গিয়েই হবে। লটবহর নিয়ে নীচে নেমে এলাম। দুটি গাড়ি দাঁড়িয়ে। একটি সেই ভদ্রলোকের, অন্যটি আমাদের জন্য। পরিচিত ভদ্রলোকের সঙ্গের গাড়িতে গেলাম আমি, আমার সঙ্গী অন্য গাড়িতে। শুরু হল পথচলা, শুরু হল কথাবলা।

রিও শহরটা জুড়েই সমুদ্র। পরপর বেশ কিছু বিখ্যাত সৈকত। কোপাকাবানা আর ইপানেমা দুটি পরিচিত নাম ছাড়াও আরও সাত-আটটি আছে শহরের পার্শ্বরেখা বরাবর। তখন সে সব মনে ছিল, এখন আর গুগলাতে ইচ্ছে করছে না। গাড়ি চলতে শুরু করার পর একে-একে সেই ভদ্রলোক নাম বলে চলেছেন। কোপাকাবানা, ইপানেমা গেল, তারপরও গোটা দুই। প্রায় মিনিট চল্লিশেক পেরিয়েছি, অধৈর্য হয়ে পড়ি এবার। গন্তব্য আর কত দূর?

‘এই তো, এসে পড়লাম বলে’ শুনতে শুনতে এবার বিরক্তি চরম। ঘণ্টাখানেক হয়ে যাওয়ার পরও যখন পৌঁছলাম না, গাড়ি থামাতে বলি, খানিকটা জোরেই। চালক থামিয়ে দেন, ভদ্রলোক থামতে রাজি নন। ‘আর একটু, আর একটু’ তখনও বলে চলেছেন। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গিয়েছে আমার। জানিয়ে দিই, ‘যাচ্ছি যখন, শেষ পর্যন্ত যাবও হয়ত, তবে থাকব না’!

‘চলুন না, জায়গাটা দেখে সিদ্ধান্ত নেবেন। যেখানে ছিলেন তার চেয়েও ভাল জায়গা। জানেনই না, স্থানীয় এই অঞ্চলেই রোমারিও এবং রোনালদোর ফ্ল্যাটও আছে।’ আগে জেনে নিই, ওঁরা থাকেন কিনা। যখন জানা গেল, থাকেন না, অল্প যেটুকু দ্বিধা তৈরি হয়েছিল, উধাও। ‘চলুন, ফিরে যাই’!

এত দূর এসেও সুসজ্জিত বাড়িটা একবার দেখবেন না? দেখলেই মন পাল্টে যাবে, আগে দেখে নিন। যতবার তিনি এমন বলেন, আমার মন আরও বিদ্রোহ করে। ঘড়ি বলছে, পৌঁছতে এক ঘণ্টা কুড়ি মিনিট মতো লেগেছে। কথা বলতে বলতেই দেখেও নিয়েছিলাম, মূল বড় রাস্তা থেকে ভেতরে ঢুকেও মিনিট পনের মতো ট্যাক্সি চলেছে। আর সেই রাস্তাটায় বাস গোছের কিছুই চলে না। অর্থাৎ, ঘর থেকে বেরিয়েই ট্যাক্সি নিয়ে বড় রাস্তায় পৌঁছতে হবে। মনস্থির, থাকব না। ভেতরে যাই, দেখে খুবই ভাল লেগেছিল। তিন-কামরার অ্যাপার্টমেন্ট, আগের চেয়েও বেশি গোছানো। কিন্তু থাকব কী করে? আমি তো ‘ভাল’ থাকতে আসিনি, কাজ করতে এসেছি!

মারাকানা থেকে প্রায় দু-ঘণ্টার দূরত্বে বাড়ি সুসজ্জিত হলেও কি থাকা সম্ভব? কাজ শেষ হয় রাতে। ম্যাচের পর প্রেস কনফারেন্স, লেখালেখি শেষ করে বেরতে আরও ঘণ্টাদুয়েক তো লাগেই। রাত এগারটা মারাকানা থেকে বেরিয়ে রাত একটায় পৌঁছব নাকি এখানে? পূর্বপরিচিত রেগে যান। এত কষ্ট করে খুঁজে এত ভাল থাকার ব্যবস্থা করলেন, আমার পছন্দ হচ্ছে না? বোঝাতে চেষ্টা করি, কাজের ব্যাখ্যা দিয়ে। বোঝেন না। বুঝলেন সেই ফ্ল্যাটের মালিক। সৌভাগ্য, তিনিও ইংরেজি বোঝেন। আমার প্রতিটি কথা মনে দিয়ে শুনে তিনিই সেই পূর্বপরিচিতকে পর্তুগিজেই বোঝালেন, সত্যিই বড় সমস্যা, আমার পক্ষে এখানে থাকা মুশকিল। তাঁদের কথার বিন্দুবিসর্গ বুঝি না। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরতে পারলে বাঁচি।

ফিরে চলো শহরে এবার। কিন্তু সেই যে অতগুলো ডলার দিয়েছিলাম হাতে তুলে প্রথম দিন, থাকলাম তো দেড়দিন, দুটো রাত। ফেরত দিন বলতেই আবার একদফা কথা কাটাকাটি। আমাকে বলা হল, ‘আপনি থাকুন এখানে, থাকার জায়গা করে দিলাম, পয়সা ফেরত আবার কী?’ এবার মাথায় রক্ত উঠতে চায়। মারাকানায় পরের দিন নামবে আর্জেন্তিনা। লিওনেল মেসিরা অনুশীলন করবেন, বিকেল-বিকেল মাঠে না পৌঁছলে আমার তো সবই যাবে। আর আমি কিনা তখনও ঝগড়া করে যাচ্ছি, রিও-র শহরতলির কোনও এক আবাসনে দাঁড়িয়ে!

 আর্জেন্তিনার সেই বিশ্বকাপে প্রথম প্রেস কনফারেন্সে সাবেয়া-রোমেরো

অগ্রাধিকার, বোঝাই নিজেকে। সেই পূর্বপরিচিতকে কড়া ভাষায় জানিয়ে দিই, আমাকে ফিরতেই হবে এখন। ওঁর কাছে ডলার সেই মুহূর্তে না থাকলেও সমস্যা নেই। আরও দিন তিনেক আছিই, পরেও দফায় দফায় আরও দিন পনের থাকব। মেল আইডি ফোন নম্বর সবই আছে। আদায় যেভাবেই হোক করব। তবে, ভাল হবে নিজেই ফেরত দিয়ে দিলে। এমন শাসানি দিয়েই বেরিয়ে আসি সেই বাড়ি থেকে।

ফেরার সময় পূর্বপরিচিত আর ওঠেন না গাড়িতে। আমরাই একটি ট্যাক্সিতে, মালপত্রসহ। ভাবছি, কোথায় যাব। থাকার জায়গা নেই। হোটেল কত দামী, জানা ছিল বলেই সেই পূর্বপরিচিতের সঙ্গে কথাবার্তা। রাস্তায় খোঁজার উপায়ও নেই। ট্যাক্সিচালককে জানাই, মারাকানা যাব। ওখানে অনেককেই দেখেছিলাম, মালপত্রসহ ঢুকতে। যদিও আমাদের মতো একেকজনের সঙ্গে দুটো সুটকেস ছিল না কারও! তবু, মনে হল ওখানে গিয়ে অন্তত ইন্টারনেটটা দেখা যাবে। প্রয়োজনে একটা রাতের জন্য বেশি টাকা খরচ করেও মাথা গোঁজার জায়গা বের করতেই হবে। তারপর অন্য সব। সুতরাং, মারাকানার প্রেস সেন্টার যাওয়াটাই ঠিক।

সেই ট্যাক্সিচালকের নাম ছিল ইগর। হ্যাঁ, ব্রাজিলে রুশ নামের চালক। তিনিও সমস্যা বুঝে দু-একটা পরামর্শ দিচ্ছিলেন। সত্যিই ভদ্র। টানা ট্যাক্সিতে ঘণ্টা দেড়েক পর মারাকানা পৌঁছেছি, তিনিই পরামর্শ দিলেন, অপেক্ষা করবেন।। সঙ্গী এবং মালপত্র রেখে আমি দৌড়ই ভেতরে।

মিডিয়া সেন্টারের বাইরে প্রশস্ত জায়গা আমাদের, সিগারেট খাওয়ার। উদভ্রান্তের মতো সেখানে ঢুকতে গিয়ে মনে পড়ে, সেই যে বাড়ি ছেড়ে বেরলাম, সিগারেটেও টান দেওয়া হয়নি। দাঁড়িয়ে পড়ি। তখনই অনতি দূর থেকে আওয়াজ, ‘আরে কাশীভাই, ক্যায়া হুয়া? আপ অচ্ছে নেহি দিখতে হো।’

উমেদ ওয়াসিম! পাকিস্তানের সাংবাদিক, ‘ডন’ কাগজের। উমেদের বয়স বছর আঠাশ। পাকিস্তানের মিডিয়া-ইতিহাসে প্রথম সাংবাদিক যে ফুটবল বিশ্বকাপ করতে এসেছে! আলাপ হয়েছিল সাও পাওলো-তেই, ওই সিগারেট খেতে গিয়ে। পাশে কেউ চোস্ত উর্দূ বলছে শুনে যেচেই আলাপ করেছিলাম। তারপর আমাদের সঙ্গী হয়ে পড়েছিল উমেদ। রিও-তে আমরা চলে আসব শুনে একই বাসে এসেছিল শুধু নয়, প্রথম রাতটা রিওতে ছিলও আমার সঙ্গেই। ওর বুকিং ছিল পরের দিন থেকে। রিওত সেই প্রথম রাতে আমাদের সেই ফ্ল্যাটে থেকে গিয়েছিল। পরের দিন সকালে ওর থাকার জায়গা যেখানে, চলে গিয়েছিল ফিফা-নির্দিষ্ট ‘হোটেল নিসে’-তে। সেই উমেদ!

মানুষ সমস্যায় পড়লে যা হয়, প্রথমে যাঁর সঙ্গে দেখা হয়, গড়গড় করে বলে ফেলে সব। দুটো সিগারেট পুড়ল দুজনেরই। সব জানালাম। উমেদ বলল, ‘কাশীভাই, আপ রুকো, ম্যায় আ রহা হুঁ।’ কী, কেন – জানতে চাই। ‘আপ রুকো ইধার’, বলে উমেদ চলে যায় ভেতরে। আমিও বোকার মতোই দাঁড়িয়ে বাইরে। মিনিট পাঁচেক, ফিরে আসে উমেদ, ল্যাপটপের ব্যাগসহ। ‘আপকা ট্যাক্সি হ্যায় না বাহার?’ জানাই, হ্যাঁ। ‘চলো, মেরে হোটেল’!

ট্যাক্সিতে উঠে জানায়, ওর হোটেলের ঘরটা যথেষ্ট বড়। একটা আলাদা বেড নিয়ে নেওয়া যাবে। সেই রাতটা ওর ঘরেই থাকা সম্ভব। তারপর নিজেরা খুঁজে নেব পরের আস্তানা। চাইলে ওর ওখানেও থেকে যেতে পারি পরের দুটো দিন, ইত্যাদি। হাতে চাঁদ আমাদের দুজনের। হ্যাঁ, আমার সঙ্গে এই গোটা ঝামেলাটা মোটামুটি মুখ চুন করে কাটিয়েছিল শুভ্র মুখোপাধ্যায়, গণশক্তি কাগজের হয়ে যে গিয়েছিল ব্রাজিলে বিশ্বকাপ ‘কভার’ করতে আর শুরুর দিনটা বাদ দিয়ে পরের রাত থেকেই সঙ্গী ছিল সেই একচল্লিশ দিন।

উমেদের হোটেলে এসে পাসপোর্ট দেখিয়ে আগে বন্দোবস্ত করে ফেলা গেল। ‘বেড’ পরে আসবে, উমেদ বলল, আগে স্নানটান সেরে, খেয়েদেয়ে তাড়াতাড়ি মাঠ ফেরার কথা। মেসি নামবে যে প্র্যাকটিসে!

বিশ্বকাপে দেখা মেসির প্রথম প্র্যাকটিস

ঝড়ের মতো সব কাগজপত্র ঠিকঠাক করে নিজেদের স্নান-খাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়ি কাজে। ফিফার হোটেল, নীচেই অপেক্ষা করে মারাকানা নিয়ে যাওয়ার বাস। তখন তিনটে মতো দুপুর। বাসে উঠে আধঘণ্টায় মারাকানা পৌঁছেই আলেখান্দ্রো সাবেয়া ও সের্খিও রোমেরোর প্রেস কনফারেন্স মিটিয়ে মাঠের ভেতর ঢুকে দেখি, প্র্যাকটিসে নামছেন মেসিরা!

কিচ্ছু ‘মিস’ করতে হয়নি, করতে দেয়নি উমেদ। রাতে ওর ঘরে বসে খুঁজে ফেলি পরের দফায় রিও-তে থাকার আস্তানাগুলো, ইন্টারনেটের সাহায্যে। সাও পাওলো-তে আইবিস-এ ছিলাম, ওদের কাছে ফোন করার পরামর্শটাও দিয়েছিল উমেদই সুবিধা হয়ে যায়, রিও-র আইবিস-এ ঠাঁই মেলে। মনে পড়ে যায় আবারও সেই পূর্বপরিচিতের প্রচ্ছন্ন হুমকি – বিশ্বকাপের মধ্যে রিও শহরের ভেতর কী করে হোটেল খুঁজে পাই আমরা, তিনি নকি দেখে নেবেন! আরও জানিয়েছিলেন, দিন তিনেক ধরে রাখবেন তাঁর সেই শহরতলির ঠিক করে-দেওয়া ফ্ল্যাটটা, কারণ আমাদের তো আবার তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে। আমিও বলে এসেছিলাম, দরকারে মারাকানা মিডিয়া সেন্টারেই থেকে যাব, ওঁর কাছে ফ্ল্যাটের জন্য যাব না আর!

পাকিস্তানি সাংবাদিক উমেদ ওয়াসিম-এর সঙ্গে

গত এই সাত বছরে উমেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব জমজমাট। এতটাই যে, রাশিয়া বিশ্বকাপের আগে থেকেই জানিয়ে দিয়েছিল, একসঙ্গে থাকবে, ‘আপ দেখ লিজিয়ে, ম্যাঁয় কুছ নেহি করুঙ্গা।’ ছিলামও। ওর বিয়েতে নেমন্তন্ন করেছিল। ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের কারণে যেতে পারিনি। ওর মিষ্টি বউ গিয়েছিল মস্কোতে ফাইনলের ঠিক আগে। কত গল্প, কত আড্ডা!

বিশ্বকাপ ‘কভার’ করতে গিয়ে অনেক কিছুর মাঝে আমার বিরাট প্রাপ্তি, পাকিস্তানের বন্ধু উমেদ ওয়াসিম। জানি এই লেখাটার একটা শব্দও পড়তে পারবে না উমেদ। তাতে কিছু যায় আসে না। ধন্যবাদ জানিয়ে ওকে ছোট করা অসম্ভব। যদ্দিন না আবার দেখা হচ্ছে, খুশ রহো ইয়ার!

Wednesday, September 30, 2020

কাশীনাথ ভট্টাচার্য / বৈচিত্র্যের রানির রাজপাট বাংলাতেও

বাংলা সিনেমার গানে বোম্বে, তৃতীয় পর্ব – আশা ভোঁসলে

লতা মঙ্গেশকারের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, গায়িকা আশা ভোঁসলে ঠিক কোন কোন দিকে এগিয়ে, ‘স্ট্রং পয়েন্ট’ কী কী?

নাসরিন মুন্নি কবীর-কে বুঝিয়ে বলেছিলেন ‘লতা মঙ্গেশকার ইন হার ওন ভয়েস’ বই-তে ‘দিদি’ লতা – ‘‘বৈচিত্র‌্য। যে কোনও ধরনের গান দিন ওকে, খুব ভাল গেয়ে দেবে। সে দুঃখের গান হোক বা হাসির, রোমান্টিক বা নাচের গান। আমার বোন বলে বলছি না, ওর গুণের কথা বলা তো আমার কর্তব্যও। যত ধরনের গান আশা গেয়েছে, মনে হয় না কারও সঙ্গে ওর তুলনা করা সম্ভব। যখন এসেছিল ইন্ডাস্ট্রিতে, একদম অন্যরকম গাইত। পরে বর্মনদার প্রভাব পড়ে ওর ওপর, নিজেকে আরও এগিযে নিয়ে যায়। বর্মনদার একটা স্টাইল ছিল, গানের কোনও লাইনে একটি কথার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া। যেমন, ‘মেরে বন যাও’–তে যাও’–এর ওপর। বাংলা লোকগীতি থেকে এই স্টাইলটি এনেছিলেন বর্মনদা। ও পি নায়ারও পরে এই স্টাইলটি রপ্ত করেছিলেন। হাওড়া ব্রিজ ছবিতে আশার আইয়ে মেহেরবানগানটা মনে পড়ছে? যেভাবে আইয়েশব্দটার ওপর বিশেষভাবে জোর দিয়েছিল, অনবদ্য। ও পি নায়ারের গানও খুব গাইত আশা। নায়ার সাহেব বরাবরই শামসাদ বেগম, গীতা দত্ত, কিশোর কুমার আর রফি সাহেবকে পছন্দ করতেন, ওঁর সুরে গান গাওয়ার জন্য। মনে করতেন, ওঁর সুর ঠিক আমার গলার জন্য নয়। আমারও বিশ্বাস, ঠিকই করতেন। ওঁর কম্পোজিশনগুলো ঠিক আমার জন্য নয়।’’

তাই বৈচিত্র্যের রানি আশা হিন্দির মতো বাংলাতেও রাজপাট সাজিয়ে বসেছিলেন নিজের মতো করেই। পাঁচের দশকের শেষ দিকে বাংলা ছবিতে আগমন। প্রথম গান, খুঁজে যা পাওয়া যাচ্ছে সালের হিসাবে, সম্ভবত, ‘গলি থেকে রাজপথ’ সিনেমায়, ১৯৫৯ সালে। ‘কে গো তুমি ডাকিলে আমারে’গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায়, সুধীন দাশগুপ্তর সুরে। পরে যে জুটিতে আরও বহু স্মরণীয় গান গাইবেন আশা। আর, পর্দায় সে গান গেয়েছিলেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়।

ছয়ের দশক ছেড়ে দিন, সাতের দশক থেকে কিন্তু প্রায় বছর কুড়ি আশা রাজত্ব করেছেন বাংলা ছবির গানে। আর সেখানে পথিকৃৎ বলা যেতেই পারে সুধীন দাশগুপ্তকে। বড় ভাল ভাল গান গাইয়েছিলেন আশাকে দিয়ে আলাদা করে বলার নেই বাঙালি শ্রোতাকে, কিছু গানের কথাই যথেষ্ট। ডেকে ডেকে চলে গেছি, কোন সে আলোর স্বপ্ন নিয়ে (প্রথম কদম ফুল, ১৯৭০); আমার দিন কাটে না, আরও দূরে চলো যাই (ছদ্মবেশী, ১৯৭১); আজ দুজনে মন্দ হলে (ফরিয়াদ, ১৯৭১); কেন সর্বনাশের নেশা ধরিয়ে, মন মেতেছে (পিকনিক, ১৯৭২); সাগর ডাকে আয় (জীবন সৈকতে, ১৯৭২); আমি অন্ধকারের যাত্রী (এপার ওপার, ১৯৭৩) এর মধ্যে আবার প্রথম কদম ফুল নিয়ে অন্য গল্প শোনা গিয়েছে। সুধীন নাকি চেয়েছিলেন ‘কোন সে আলোর স্বপ্ন নিয়ে’ গাইবেন লতা! দেখা করতেও গিয়েছিলেন লতার সঙ্গে। সেই দিন, কোনও কারণে, ‘দিদি’ ছিলেন না প্রভু কুঞ্জে। ‘বোন’ আশার সঙ্গে কথা হয়, ‘ডেকে ডেকে’ নিয়ে। দিদির কোন গানটা, জানতে চেয়েছিলেন আশা। শুনে নাকি বলেছিলেন, গাইলে দুটি গানই গাইবেন, না হলে একটাও নয়। অগত্যা, কী-ই বা করতে পারতেন আশার ‘সুধীনদা’ তখন!

যদি কানে কানে কিছু বলে বঁধুয়া

বাংলা ছায়াছবিতে আশার জনপ্রিয়তা বেড়ে যাওয়ার অবশ্যই বড় কারণ রাহুল দেব বর্মনকিন্তু তারও আগে শ্যামল মিত্রর নাম নিতেই হবে রাহুল যখন অনুসন্ধান ছবিতে ‘আমার স্বপ্ন যে সত্যি হল আজ’-এ কিশোরসঙ্গী করেছেন লতাকে, শ্যামল কিন্তু তার আগে কিশোরের সঙ্গে আশার ডুয়েট করে ফেলেছেন ‘আমার স্বপ্ন তুমি ওগো চিরদিনের সাথী’ গানে, আনন্দ আশ্রম ছবিতে, ১৯৭৭ সালে। সবচেয়ে বড়, শ্যামল মিত্রর সুরে আশার যেখানে বাংলা ছবিতে অসংখ্য মনভোলানো গান, লতার নেই-ই। সেই ‘নেই সেই পূর্ণিমা রাত’ দিয়ে শুরু। ১৯৭৬ সালে অজস্র ধন্যবাদ ছবির সব গানই ফিরত লোকের মুখে-মুখে। ববি-খ্যাত শৈলেন্দ্র সিংকে নিয়ে এসেছিলেন শ্যামল, ‘নদী যদি বলে সাগরের কাছে আসব না’ যেমন মনে রেখে দিয়েছেন বাঙালি শ্রোতা, আশার ‘প্রেম কথাটাই ছোট’ গানটিও। আলাদা উল্লেখ এই জন্যই যে শ্যামলের নিজের ছায়া ঝরা ভরা সাঁঝে এবং তুমি যে আমারই গান-ও এই একই ছবির, দ্বিতীয় গানটি আবার সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ও গেয়েছিলেন। তারই মাঝে এই দুটি গান এবং আশা-শৈলেন্দ্রর দ্বৈত ‘কাছে আছ তুমি’ আলাদা করে মনে থেকে যাওয়াও বড় সাফল্য।

পরে শ্যামলের সুরে আরও কত গান! জানি না আজ যে আপন, না না না না এমন করে (অমানুষ ১৯৭৫), ভালবেসে ডেকেই দেখো না (আনন্দ আশ্রম, ১৯৭৭); আমি কে সে কি ভুলে গেলে, নেশা তুমি যতই করো (কলঙ্কিনী, ১৯৮১); কুঞ্জবিহারী হে গিরিধারী (মায়ের আশীর্বাদ, ১৯৮২)। জয়যাত্রা শুরু যেন তাঁর হাত ধরেই পরে, একান্ত আপন, ত্রয়ী বা তিনমূর্তি-তে পঞ্চম স্বাভাবিকভাবেই আশা ছাড়া অন্য কারও দিকে তাকাননি

আটের দশকে একটি ছবি এসেছিল, দীপঙ্কর দে ও অপর্ণা সেন জুটিতে, মোহনার দিকে সুরকার ছিলেন আরডি-র একসময়ের সহকারী স্বপন চক্রবর্তী ছবিতে মোট ছটি গান, একটি কিশোর কুমারের, ‘নাই নাই এ আঁধার থেকে ফেরার পথ নাই বাকি পাঁচটি গান আশারআছে গৌর নিতাই নদীয়াতেসব পুজো প্যান্ডেলে যদিমাস্টহয়ে থাকে, ‘কে যেন আবীর ছড়িয়ে দিল ভোরের আকাশেএবংরামধনু রঙ নিয়ে আমি খেলাঘর বেঁধেছি’, গানদুটি শুনলেই মনে হয় সুরারোপ করেছিলেন আরডি স্বয়ং! আর লালকুঠি ছবিতে স্বপন-জগমোহনের সুরেও আশাই, ‘তারে ভোলানো গেল না কিছুতেই’!

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রক্সিতে সবাইকে দিয়েই একটি করে দুরন্ত গান গাইয়েছিলেন। আশার ‘যখন তোমার গানের সরগম’ অন্যতম। বিশেষভাবে মনে করা যেতে পারে ভূপেন হাজারিকার সুরে চামেলি মেমসাহেব ছবিতে ‘কখগঘ চছজঝ এবিসিডি নিয়ে গো’। ছবি ততটা সফল না হলেও কখগঘ-র সাফল্য প্রশ্নাতীত। যেমন, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ও ‘যদি কানে কানে কিছু বলে বঁধুয়া’ গাইয়েছিলেন জীবন রহস্য ছবিতে।

শেষ দিকে আরডি থাকাকালীন এবং আরডি-র পর, বাপি লাহিড়ি বেছে নিয়েছিলেন আশাকে, একই রকম চমকপ্রদ কিছু গানের ক্ষেত্রে। বরাবরই আশা নতুন প্রজন্মের সুরকারদের সঙ্গে সমান স্বচ্ছন্দ্য। এখনও তিনি নতুন কোনও গান করে ফেলবেন না, নিশ্চয়তা দেওয়া যায় কি? আর, তিনি গাইলে সেই গানের আকর্ষণ এবং আবেদন অন্য স্তরে পৌঁছবেই, সে-ও তো নিশ্চিত!

 

আশা ভোঁসলে (বাংলা ছায়াছবির জনপ্রিয় কিছু গান)

সুরকারশ্যামল মিত্র

নেই সেই পূর্ণিমা রাত (রাজকন্যা, ১৯৬৫); যদি হই চোরকাঁটা ওই শাড়ির ভাঁজে (কিশোর), জানি না আজ যে আপন, না না না না এমন করে (অমানুষ ১৯৭৫); কাছে আছ তুমি (শৈলেন্দ্র), নওল কিশোর শ্যামসুন্দর (শৈলেন্দ্র, রফি, শ্যামল), প্রেম কথাটাই ছোট (অজস্র ধন্যবাদ, ১৯৭৬); আমার স্বপ্ন তুমি ওগো (কিশোর), ভালবেসে ডেকেই দেখো না (আনন্দ আশ্রম, ১৯৭৭); আমি কে সে কি ভুলে গেলে, কোনও কাজ (কিশোর), একই সাথে হাত ধরে (কিশোর), নেশা তুমি যতই করো (কলঙ্কিনী, ১৯৮১); কুঞ্জবিহারী হে গিরিধারী (মায়ের আশীর্বাদ, ১৯৮২)

সুরকাররাহুল দেববর্মন

গুন গুনগুন কুঞ্জে আমার (কিশোর), বন্ধ ঘরের অন্ধকারে, সে কি এল (রাজকুমারী, ১৯৭০); ফুলকলি রে ফুলকলি (কিশোর, অনুসন্ধান, ১৯৮০); আধো আলো ছায়াতে (কিশোর), ও আমার কাঁধের আঁচল (কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী, ১৯৮১); জানা অজানা পথে চলেছি (কিশোর, আরডি), আরও কাছাকাছি (কিশোর), একটু বোসো চলে যেও না, কথা হয়েছিল (ত্রয়ী, ১৯৮২); বান্দার সেলাম নাও জনাব (আরডি), নতুন সে তো নতুনই (কিশোর), জানো যদি এ মন কী চায় (তিনমূর্তি, ১৯৮৪); নাগর আমার কাঁচা পিরীত (শৈলেন্দ্র, অন্যায় অবিচার, ১৯৮৫); না না কাছে এসো না (এসপি), এমন মধুর সন্ধ্যায়, হায়রে কালা এ কী জ্বালা, তোলো ছিন্নবীণা, খেলব হোলি রঙ দেব না (একান্ত আপন, ১৯৮৭); শ্যাম ঘনশ্যাম তুমি (আগুন, ১৯৮৮)

সুরকারসুধীন দাশগুপ্ত

ডেকে ডেকে চলে গেছি, কোন সে আলোর স্বপ্ন নিয়ে (প্রথম কদম ফুল, ১৯৭০); আমার দিন কাটে না, আরও দূরে চলো যাই (ছদ্মবেশী, ১৯৭১); আজ দুজনে মন্দ হলে (ফরিয়াদ, ১৯৭১); কেন সর্বনাশের নেশা ধরিয়ে, মন মেতেছে (পিকনিক, ১৯৭২); সাগর ডাকে আয় (জীবন সৈকতে, ১৯৭২); আমি অন্ধকারের যাত্রী (এপার ওপার, ১৯৭৩)

সুরকারহেমন্ত মুখোপাধ্যায়

মেঘের কোলে রোদ হেসেছে (রবীন্দ্রসঙ্গীত, কুহেলি, ১৯৭১); যখন তোমার গানের সরগম (প্রক্সি, ১৯৭৭)

সুরকারঅভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

যদি কানে কানে কিছু বলে বঁধুয়া, ও পাখি উড়ে আয় (জীবন রহস্য, ১৯৭৩)

সুরকারনচিকেতা ঘোষ

পাগলা গারদ কোথায় আছে (মান্না), বেশ করেছি প্রেম করেছি (মৌচাক, ১৯৭৪); আলো আর আলো দিয়ে (স্বয়ংসিদ্ধা, ১৯৭৫)

সুরকারশচীন দেব বর্মন

গুঞ্জনে দোলে যে ভ্রমর (কিশোর, আরাধনা, ১৯৭৬)

সুরকারভূপেন হাজারিকা

কখগঘ চছজঝ (চামেলি মেমসাহেব, ১৯৭৮)

সুরকারস্বপন-জগমোহন

ঢলে যেতে যেতে (কিশোর), কে যায় রে, তারে ভোলানো গেল না (লালকুঠি, ১৯৭৮); জাফরানি রঙ আকাশে (প্রহরী ১৯৮২)

সুরকারবীরেশ্বর সরকার

এক যে ছিল রাজপুত্তুর (কিশোর, মাদার, ১৯৭৯)

সুরকারবাপি লাহিড়ি

তুই যত ফুল দিস না কেনে (ওগো বধু সুন্দরী, ১৯৮০); জানো নাকি তুমি কোথায় (বাপি), তোমরা পয়সা দিয়ে গানকে কেনো, আমি ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখা (প্রতিদান, ১৯৮৩); বলো তো কী করে ঘর বাঁধা যায় (বাপি), ওই নীল পাখিটাকে (বাপি), প্রেম কিসে হয় (দুজনে, ১৯৮৪);  এক যে ছিল দুয়োরানি (প্রতিকার, ১৯৮৭); যেখানেই থাকো, আমি মন দিয়েছি, তোমার মুখটা কী সুন্দর, চিরদিনই তুমি যে আমার (অমরসঙ্গী, ১৯৮৭); আকাশের চাঁদ, ফুল কেন লাল হয় (গুরুদক্ষিণা, ১৯৮৭)

সুরকারঅজয় দাস

আমারই এ কণ্ঠ ভরে (জীবন মরণ, ১৯৮৩); বৃষ্টি থামার শেষে (পারাবত প্রিয়া, ১৯৮৩); গুনগুন করে মন ভ্রমরা যে ওই (অমিত), এ মন আমার হারিয়ে যায় (অনুরোগের ছোঁয়া, ১৯৮৬)

সুরকারমৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়

ঝরঝর ঝরে (অমিত), এই মনটা যদি না থাকত, আমার কুয়াশা যে ওড়না (দুটি পাতা, ১৯৮৩)

সুরকারস্বপন চক্রবর্তী

আছে গৌর নিতাই, বন্ধ মনের দুয়ার দিয়েছি খুলে, এই রাতে একটুখানি কাছে, কে যেন আবীর, রামধনু রঙ নিয়ে (মোহনার দিকে, ১৯৮৪); কথা দিলাম (কিশোর) আজ আমি অচেনা যে (সুরের আকাশে, ১৯৮৮)