Sunday, April 12, 2020

প্যারাবোলা-পদ্ধতি, পিলকম এবং ইংরেজিতে প্রথম ‘বাইলাইন’ / কাশীনাথ ভট্টাচার্য


কাশীনাথ ভট্টাচার্য

অমৃতবাজার পত্রিকা, ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৫
‘বিশ্বাসঘাতক’ নারায়ণ সান্যালের সঙ্গে প্রথম পরিচয় বীরপাড়ার জুবিলি ক্লাব লাইব্রেরিতে, বন্ধু টুকাইয়ের (অভিজিৎ ঘোষদস্তিদার) সৌজন্যে। জলপাইগুড়ি থেকে জোরালো চিঠি-নির্দেশ, পড়তেই হবে। না-পড়লে পিছিয়ে পড়ব, এতটা বলেনি! কিন্তু, পড়ে ফেললাম এবং ‘ফিদা’। আমি তখন দশম শ্রেণী, আমি তখন ফুলপ্যান্ট!
এগারয় আলাপ প্যারাবোলার সঙ্গে, প্যারাবোলা-স্যরের সঙ্গেও। ‘ঋণাত্মক রাত’ কী করে ‘ধনাত্মক দিন’-এর দিকে এগিয়ে যায়, বা ছবিতে মালা ঝোলে প্যারাবোলা-র আকৃতিতে ইত্যাদি। কী করে বিয়ের পর মানুষের জীবন বৃত্ত (সার্কেল) থেকে চেপ্টে উপবৃত্ত  (ইলিপ্স) হয়ে যায়, একটি কেন্দ্র থেকে দুটি ‘কেন্দ্রবিন্দু’-তে স্থানান্তরিত (যাঁরা আঁক কষেছেন বারো ক্লাসে, সমীকরণে বুঝতে পারবেন হয়ত, x2 + y2 = a2 থেকে x2/a2 + y2/b2 = 1), তখন নিজের বোঝার ক্ষমতা ছিল না, কিন্তু, মনে থেকে গিয়েছিল অঙ্ক দিয়ে জীবনকে বোঝানোর সহজ উপায়। ততদিনে আমি পুরোপুরি সান্যালবাবুর জালে। মুখস্থ করছি, অঙ্কের ফর্মূলার মতো। ইনটিগ্রেশন বাই পার্টস-এ হাবুডুবু খেতে খেতেও আঁকড়ে ধরছি সান্যালবাবুর বই।
অঙ্ক নিয়ে খানিকটা পাগলামি ছিল আমারও, অস্বীকার করছি না। তবে, খবরের কাগজের পাতায়ও অঙ্ক কষব, সেই প্যারাবোলা নিয়ে, চাকরি জীবনের শুরুতে কখনও ভাবিনি এমন!
বাধ্য হয়েছিলাম ১৯৯৫ সালে। তখন যুগান্তর স্পোর্টসে চাকরি। কয়েক মাস পরেই ১৯৯৬ ক্রিকেট বিশ্বকাপ। আমাদের দেশের সঙ্গে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা জুড়ে খেলা। তিন দেশের নামের আদ্যক্ষর নিয়ে তৈরি ‘পিলকম’ (পাকিস্তান-ইন্ডিয়া-লঙ্কা কমিটি) দায়িত্বে। আহ্বায়ক ছিলেন জগমোহন ডালমিয়া। সন্ধেয় সিএবি ঘোরা নিয়ম। অফিস থেকেই নির্দেশ, ‘স্টোরি’ করতে হবে।
‘স্টোরি’ খুব বেশি হয় না আমার, অক্ষমতায়। একে তো আনকোরা, বছরদুয়েক হয়েছে সবে। ট্রেনি থেকে সবে উত্তরণ। আমাকে চেনেনই বা কে যে ‘স্টোরি’ দেবেন? সিএবি-তে তখন চাঁদের হাট। চিত্রক মিত্র, প্রবীর মুখার্জি, গৌতম দাশগুপ্তরা আছেন। সদ্য-পরিচিতের জন্য স্টোরি তাঁদের থেকে পাওয়া যায় না। কেনই বা দেবেন, কোন যোগ্যতা ছিল আমার? জগুদা-র (ডালমিয়া) ঘরে ঢুকে একেবারে পেছনের সারিতে চুপ করে বসে থাকি, যা বলেন শুনি আর এসে লিখে ফেলি, ব্যস্।
সেই সময় এক দিন ফোন পেলাম স্কটিশের পরিচিত এক দাদা-কাম-বন্ধুর। ওঁদের সংস্থায় স্পোর্টস কুইজ আয়োজন করতে চাইছেন। যেহেতু আয়োজক, উনি কুইজ মাস্টার হতে পারবেন না। আমাকে সেই দায়িত্ব নিতে হবে। আমাদের স্কটিশ-যোগ বরাবরের। তাই নির্দিষ্ট দিনে হাতে একতাড়া প্রশ্ন নিয়ে হাজির সেই ঝাঁ চকচকে অফিসে।
যুগান্তর, ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৯৫

ওখানে একটা প্রশ্ন করেছিলাম, যত দূর মনে পড়ে, বিরানব্বই বিশ্বকাপে ‘রেইন-রুল’, যা তুমুল বিতর্কের ঢেউ তুলেছিল ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে, কার মস্তিষ্কপ্রসূত?
এই প্রজন্মের জন্য বিশদেই বলি যাঁরা তখন খেলা দেখার বা সেই বিতর্কে ঢোকার সুযোগ পাননি। নিয়মটি তৈরি করেছিলেন সর্বশ্রী রিচি বেনো। অস্ট্রেলীয় বেনো ক্রিকেটার হিসাবে যেমন, পরে ধারাভাষ্যকার হিসাবেও সর্বোচ্চ শ্রেণীতে।
এমনিতেও আমার ক্রিকেটজ্ঞান সীমিতর চেয়েও অনেকটা কম। কিন্তু নিয়মটা আমার সেই দিন থেকেই অপছন্দ যে দিন মহম্মদ আজহারউদ্দিনের দুর্ধর্ষ একটা ইনিংস (৯০-পেরনো, ৯১-৯২ হবে বোধহয়, ক্রিকইনফো দেখলাম না আর!) মাঠে মারা গিয়েছিল, অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে, ওই নিয়মের জাঁতাকলে, সেই দিন থেকে। তখন থেকেই নিয়মটার নাম দিয়েছিলাম ‘বেনোজল’, ক্রিকেটার-ধারাভাষ্যকার বেনোকে মাথায় রেখেই।
নিয়মটা কী ছিল? বৃষ্টির কারণে যদি পরে ব্যাট-করা দলের ওভার সংখ্যা কমে যায়, নতুন ‘টার্গেট’ তৈরি হবে আগে ব্যাট-করা দলের খেলা সবচেয়ে কম রানের ওভারগুলো বাদ দিয়ে। এভাবে বললে বোঝাতে অসুবিধা হতে পারে। ধরুন, আগে ব্যাট করে কোনও দল ২৫৭ রান তুলল। বিপক্ষকে জিততে হলে তুলতে হবে ২৫৮, সহজ। কিন্তু বিপক্ষ ব্যাট করতে নামার পর, ইনিংসের মাঝে বৃষ্টি এল ঝেঁপে। বাদ গেল পাঁচ ওভার। তখন দেখা হবে, প্রথমে ব্যাট-করা দল সবচেয়ে কম রান তুলেছে কোন কোন ওভারে? দেখা গেল, ইনিংসের তৃতীয় ও সপ্তম ওভার মেডেন ছিল, ১৬ ও ৩১তম ওভারে একটি করে রান উঠেছিল, ২৭তম ওভারে দুই। অর্থাৎ, ইনিংস থেকে পাঁচ ওভার বাদ গেল, ‘টার্গেট’ কমল মাত্র চার রান। জিততে হলে বিপক্ষকে তখন ২৫৮-৪ = ২৫৪ রান তুলতে হবে, পাঁচ ওভার কম খেলে!
সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার এক বলে ২২ রানের অবাস্তব ‘লক্ষ্য’ তো সবারই মনে আছে,অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ভারতের ওই একই সমস্যা হয়েছিল। বৃষ্টির পর তিন ওভার কমে গিয়েছিল। ‘ভিলেন’ হয়ে গিয়েছিলেন কপিলদেব নিখাঞ্জ নামের এক ব্যক্তি। নিজের কোটার দশ ওভারে দুটি মেডেন নিয়েছিলেন তিনি, একটিতে দিয়েছিলেন মাত্র এক রান। ফলে, ভারতের কোটা থেকে যখন তিন ওভার কমে গিয়েছিল, লক্ষ্য কমেছিল মাত্র এক রান!
সেমিফাইনালের বহু আগে, সেই গ্রুপ লিগের ম্যাচের সময়ই মনে হয়েছিল, একদিনের ক্রিকেটে ‘মেডেন’ নেওয়া যখন বিশেষ কৃতিত্ব, কেন তার এভাবে অবমূল্যায়ণ হচ্ছে? বৃষ্টি এলেই মেডেন নেওয়া বোলার ভয়ে কাঁপছেন যেন, ‘এই রে আমার দিকে এবার আঙুল উঠবে, আমি তো একটা ওভারে একটাও রান দিইনি!’
তো, সেই দিন সেই কুইজের শেষে সেই দাদা-কাম-বন্ধু জানতে চেয়েছিলেন আমার কাছে, ‘এবারের বিশ্বকাপে নতুন যে প্যারাবোলা-পদ্ধতিতে টার্গেট বেছে নেওয়া হবে, জানিস তো?’ আমি একেবারেই আকাশ থেকে পড়ি। কোনও কাগজে তো পড়িওনি। ওয়েবসাইট বা চ্যানেল তখনও জন্মায়নি। জানতে চাইলাম। শোনা গেল, এমনই হতে চলেছে প্লেয়িং কন্ডিশনে। সেই দাদা সেটা দেখেছেন, ডকুমেন্ট আছে তাঁর কাছে। হাতেপায়ে ধরে ফেলি প্রায়। পরের দিনই সোজা তাঁর বাড়ি। ‘কপি’ করিয়ে রেখেছিলেন, আর বারবার বলেছিলেন, তাঁর নাম যেন কোথাও না থাকে। আমি এখনও গোপনই রাখলাম, এই ২৫ বছর পরও!
মুশকিল হল স্টোরিটা লিখে ফেলার পর। তখন যুগান্তর-এ কম্পিউটার ছিল। কিন্তু খটোমটো কম্পোজ-এ সমস্যা। যেমন ধরুন ইংরেজিতে x2 কীভাবে লেখা হবে? ‘মাইক্রোসফট ওয়ার্ড’ তখনও আজকের মতো নয়। যে ছবিটা ছিল সঙ্গে সেখানে আবার ইংরেজিতে লেখা। বাংলা কাগজে সেগুলো কী করে দেওয়া হবে? ছবিটাই বা কী করে আঁকা হবে? যুগান্তর-এ প্রকাশিত লেখায় দেখতে পাবেন, যে ছবিটা ছাপা হয়েছিল, আদৌ তা ‘প্যারাবোলা’ নয়। পাশে আমাকে বসিয়ে যিনি মাউস ধরে ধরে এতটা কাছাকাছি এঁকেছিলেন, মনে নেই, ক্ষমাপ্রার্থনায় আন্তরিক আমি। কিন্তু তারও আগে এটা নিয়েই তর্ক ছিল, স্টোরিটা কি আদৌ ছাপা হবে? ছাপার যোগ্য? খেলার পাতায় এই সব অঙ্কের আঁকিবুকি কি পাঠক পড়বেন? এতটা জায়গা নষ্ট করা কি উচিত হবে?
সন্ধেবেলায় যখন স্টোরি নিয়ে এমন আলাপ চলছে যুগান্তর ডেস্কে, আমি যথারীতি এপাশ-ওপাশ ঘুরছি। আমাদের খেলার দায়িত্বে তখন শান্তিপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়, অমৃতবাজার পত্রিকায় গৌরীশঙ্কর মিত্র, সবচেয়ে সিনিয়র হিসাবে। স্পোর্টস এডিটর বলতে যাঁকে বোঝায়, যদ্দূর মনে পড়ছে, কেউ ছিলেন না। কিছু দিন আগেই এক লম্বা-সুদর্শন ছেলে এসেছিল অমৃতবাজারে। অমিতাভ দাসশর্মা। এখন যে দ্য হিন্দু-র প্রতিনিধি। অমিতাভ-র নাম এখন বদলে হয়ে গিয়েছে ‘এডিএস’, তখন আমরা অমিতাভই বলতাম। দুজনে দাঁড়িয়ে সিগারেট সহযোগে গপ্পো করছি, ওকে বলেই ফেলি, স্টোরি-টার কথা। একই সঙ্গে অনুরোধও, ইংরেজিতে যদি নেওয়া যায়।
কথা বলে ফেলেছিল গৌরীদার সঙ্গে। বাংলাটা যত বড় লেখা হয়েছিল ইংরেজিতে, ছোট করতে বলেছিলেন গৌরীদা। এবার সমস্যা আমার। ইংরেজিতে লিখব? ভুলভাল লিখব তো! আবার সেই অমিতাভকে পাকড়াও করি। নির্ভরতা দেয়, ‘তুমি লিখে ফ্যালো, আমি দেখে নিচ্ছি’। অগত্যা আমি লাইব্রেরিতে গিয়ে ইংরেজি লিখতে বসি খাতা-পেন নিয়ে। তখনও আমরা লেখার জন্য নিউজপ্রিন্টের প্যাডগুলোই ব্যবহার করতাম।
লিখে নিয়ে গেলাম অমিতাভর কাছে। পরীক্ষাপত্রের মতো টেনশন। পড়ল পুরোটা, বলল, ‘ঠিকই তো আছে, চিন্তু করছ কেন? হয়ত আর একটু ছোট করতে হতে পারে, ওটা আমি করে নিচ্ছি, তোমাকে দেখিয়ে নেব।’ নিশ্চিন্তে এবার যুগান্তর স্পোর্টস ডেস্কে আবার।
ততক্ষণে সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছিল, বাংলায় পুরোটাই যাবে, খেলার পাতায় ‘লিড’। কোনও ‘অফিসিয়াল কোট’ ছাড়াই স্টোরি, শুধু আমার কথায় ভরসা রেখে - ভাল লেগেছিল, অস্বীকার করব কেন? একই সঙ্গে আবার ইংরেজিতেও খেলার পাতায় ‘অ্যাঙ্কর’। একই স্টোরি, একই সংস্থার দুটি ভিন্নভাষার কাগজে, একই দিনে বেরচ্ছে – ভাল লাগারই তো কথা!
ইংরেজি কাগজে প্রথম ‘বাইলাইন’ - ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৫।
***
কয়েক মাস পর ছিয়ানব্বইয়ের ফেব্রুয়ারিতে বেরল সেই বহু প্রতীক্ষিত  বিশ্বকাপের ‘প্লেয়িং কন্ডিশন’ নিয়ে ছোট বই। জগুদার ঘরে আমরা, হাতে-হাতে পৌঁছল সবারই। বইটা পেয়েই পেছনের দিকে। মাস পাঁচেকের চাপা টেনশন উড়ে গেল যখন দেখলাম সত্যিই সেই প্যারাবোলা-পদ্ধতি আছে, যা আঁক কষে দেখিয়ে দিয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার এক সতের বছরের ছাত্র ওয়েন ডো রেগো, আমি যাঁর কথা লিখেছিলাম সেই সেপ্টেম্বরের স্টোরিতে। তত দিনে আমি দলবদলের বাজারে যুগান্তর ছেড়ে বঙ্গলোক বলে আর একটি কাগজে।
বঙ্গলোক, ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬

খারাপ লেগেছিল সেই প্লেয়িং কন্ডিশনে ওয়েনের নাম না-দেখে। সেটাই লিখেছিলাম তখন বঙ্গলোক-এ। রইল সেই লেখাটাও, ১৯৯৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত।
আর, ময়দানে দু-তিনজন সিনিয়র সাংবাদিক, যাঁদের সঙ্গে নিয়মিত দেখা আর হয় না এখন, বলতেন, ‘তোর সেই খেলার পাতায় অঙ্ককষাটা কিন্তু মনে আছে এখনও’ – প্রাপ্তি!


Thursday, April 2, 2020

ব্রাজিলে প্রথমেই পেলে! / কাশীনাথ ভট্টাচার্য


যা লিখেছিলাম, যেভাবে বেরিয়েছিল মিড ডে কাগজে...
কাশীনাথ ভট্টাচার্য

ভোররাতেই বিপত্তি!

ব্রাজিলে প্রথম রাত। সাও পাওলোর হোটেলের ঘরে একা। বাইশ ঘন্টার বিমানযাত্রার পর ঘন্টা দুই গাড়িতে। কোনও রকমে ঘরে ঢুকে স্নান সেরে কিছু খেয়েই ঘুম। মনেই ছিল না মোবাইল-ঘড়িতে অ্যালার্ম দেওয়ার কথা। পরদিন সকাল-সকাল উঠেই যেতে হবে আরেনা কোরিন্থিয়ান্সে, বিশ্বকাপ কভারকরার জন্য অ্যাক্রিডিটেশন কার্ডতুলতে। মাথায় ওই চিন্তা নিয়েই বিছানায়। আর, ঘুম যখন ভাঙল? মোবাইল-ঘড়ি দেখাল সাড়ে এগারটা!

জেট-ল্যাগ কাটানো ঘুম বলে কথা! কিন্তু, সময় দেখে চোখ কপাল ছাড়িয়ে টাকে! কখন মাঠে যাব, কখন কার্ড তুলব? স্নান-টান সেরে নিলাম চটপট। পাটভাঙা ধুতি হয়, জামা কি বলা যায় ইস্তিরিভাঙা? কে জানে, ভাবার সময়ও নেই। চটপট দেখে নিলাম ফিফার পাঠানো ইমেল-এর প্রিন্ট আর পাসপোর্ট ব্যাগে আছে কিনা। দুগ্গা দুগ্গাবলে বেরিয়ে পড়া, ঘর লক করে।

সাততলা থেকে রিসেপশনে নেমে কফি মেশিন দেখে থমকে যাওয়া। ঘুম থেকে উঠে যে কিছুই খাইনি, মনে পড়ল যেন। পাশে ব্রেকফাস্ট-এর ঘর। কিন্তু, বড়-বড় করে লেখার সারকথা, ‘সাড়ে দশটার পর খাবার চাহিয়া লজ্জা দিবেন না। পর্তুগিজ ভাষায় পণ্ডিত নই। যা লেখা ছিল ইংরেজির ওই টেনআর থার্টিপড়েই বুঝে নেওয়া। আমার সময় তখন বারটা দশ। খামোখা ভেবে লাভ নেই, চটপট কফিটা খেয়ে ট্যাক্সিতে ওঠ্ রে, ব্রাজিলে প্রথম সকালটাই মাখিয়ে ফেললি কাশীমনে মনে নিজেকে অশ্রাব্য কিছু বলে কফির জন্য দাঁড়ালাম। চিনি-ছাড়াবোঝাতে প্রাণান্ত। নাটক শিখিনি, হাত নেড়ে বোঝানোও সমস্যা। কোনও রকমে বুঝল মিষ্টি মেয়ে। নজর সরাইনি। ঠিক যা ভেবেছিলাম! শেষে চিনির দুটো পাউচ এগোতেই না নাবলে ফেরত। তৃপ্তির চুমুক ব্রাজিলের বহুকালের শোনা বিখ্যাত কফিতে।

দৃষ্টি অবশেষে সামনে এবং আবারও চোখে অবিশ্বাস! বাইরেটা এত কালো কেন?

বুদ্ধিদীপ্ত চোখে চশমা, ছিপছিপে লম্বা, ইংরেজি-জানা এরিক গত রাত থেকে তখনও কাজে। কী ব্যাপার বলুন তো, এত অন্ধকার কেন বাইরে, জিগ্যেস করেই ফেললাম, কফিতে আরও দুটো চুমুক মেরে। ঠোঁট চওড়া হল, ‘রাত তিনটে পঁয়তাল্লিশ বাজে, অন্ধকার তো থাকবেই। আপনাদের ইন্ডিয়ায় কি… ’ কথা শেষ করতে দিই না এরিককে। মোবাইল বলছে সোয়া বারোটা। মাথা খুলল তখন। সাও পাওলো বিমানবন্দরে নেমে ভেবেছিলাম, ঘড়ির সময়টা বদলে নেব, ভারত থেকে ব্রাজিলে। ভুলে গিয়েছি। সাড়ে আট ঘন্টা এগিয়ে চলছি আমি, ভারতীয় সময়ানুসারে!

অগত্যা কফি শেষ করে, কনকনে ঠাণ্ডায় হোটেলের মূল ফটকের বাইরে দাঁড়িয়ে একটি সিগারেট শেষ করে আবার পাততাড়ি গুটিয়ে সাততলার ঘরে। ইস্তিরিভাঙা জামা-প্যান্ট ছেড়ে কম্বলের তলায়। ঘড়িকে ব্রাজিলের সময়ে পরিবর্তিত করে, সকাল আটটায় অ্যালার্ম দিয়ে, আবারও ঘুমের দেশে।

গৌরচন্দ্রিকা এত বড় হলে রাগ করতেই পারেন, অধিকার আছে চটে যাওয়ার। কিন্তু, নিরুপায়। দিনের শুরুতেই এমনবিপত্তি বললে সেই এমনটা যে ঠিক কেমনবুঝিয়ে বলার দায় থাকে। তাই, (পেলের) ধান ভানতে শিবের (থুড়ি, সময় পরিবর্তনে বিপত্তির) গীত!

দিনের শেষে অবশ্য এই শর্মাই গলা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে মুণ্ডপাত করছিল ইংরেজি প্রবাদের। কোন হালায় কইসে রে, (বঙ্গানুবাদে) দিনের শুরুটা কেমন হল দেখে সারা দিনটা কেমন যাবে আন্দাজ করা যায়? গলায় ফিফা বিশ্বকাপের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড, পকেটে পেলের প্রেস কনফারেন্স, সঙ্গে আবার ক্যামেরায় পেলের ছবিও! ওভাবে দিন শুরু করে সেই দিনের শেষেই এগুলো সম্ভব?

প্রবাদকেও প্রমাদ বানিয়ে দেওয়া সেই সৃষ্টিছাড়া দিনে আসলে দ্বিতীয়বার ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই সব পায়ে-বলে ঠিকঠাক। ভাষা বিভ্রাট সম্পর্কে সম্যক ধারণা আগের রাতেই হয়ে যাওয়ায় ইংরেজি ছেড়ে বাংলায় ফিরে এসেছিলাম সেই সকাল থেকেই। তাতেই বোধহয় সিদ্ধিলাভ! একা একাই ট্যাক্সি চড়ে আরেনা কোরিন্থিয়ান্স-এ। কার্ড তোলা, পরিচিত সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা, গল্প। কলকাতার কয়েকজন আরও আগে গিয়েছিলেন। যা হয় বিদেশে তারপর। গপ্পোগাছা, কী কী কপিপাঠানো হল, চর্চা। আমি তখনও খাতা খুলিনি। তাই কিছু বলার নেই, শুধুই শোনা। লুকোনরও কিছুই নেই যে!

একই অবস্থা ছিল ধীমানেরও। ধীমান সরকার, হিন্দুস্তান টাইমস-এর মস্ত ফুটবল-লিখিয়ে। ব্রাজিল ওর তৃতীয় বিশ্বকাপ। কলকাতা থেকে একসঙ্গেই গিয়েছিলাম, একই ফ্লাইটে। বিয়াল্লিশ দিন পর ফিরবও একসঙ্গেই। কার্ড তুলে গপ্পো করছি, ধীমানই জানতে চাইল, সন্ধেবেলা কী করব। মনে হল, গল্প একটা আছে বোধহয়। ধীমানের বন্ধু আবার ফিফায় ভলেন্টিয়ার। ঘোড়ার মুখের খবর, জারদিম পাউলিস্তা যেতে হবে। পাঁচতারা হোটেল স্কাই। ফুটবল পত্রিকার উদ্বোধন। কাফু থাকছেন। সাও পাওলো তো কাফুরই শহর। আর ছিল সেই ব্রাজিল যাত্রার যা অন্যতম কারণ - পেলে নাকি আসতে পারেন!
সেই অনুষ্ঠানে সেই দুজন যাঁদের ঘরে ব্রাজিলের পাঁচ বিশ্বকাপ!


সাংবাদিক হিসেবে লুকোচুরির কিছু নিয়ম আছে। চুপি চুপি নয়, বেরিয়ে গেলাম সবাইকে টা-টা করেই। সন্ধে সাতটায় শুরু অনুষ্ঠান। সাও পাওলোর মেট্রো চেপে খানিক দূর। তারপর অনেকটা ট্যাক্সি এবং গন্তব্যে পৌঁছন নির্ধারিত সময়ের মিনিট পনের আগে। ধীমানের তো ইনভিটেশনও ছিল। আমি রবাহুত! দুজনেরই টেনশন ছিল, আমার প্রবেশাধিকার নিয়ে। বাড়তি কনফিডেন্স আনল গলায় ঝোলানো ফিফা বিশ্বকাপের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড। বেশ মেজাজেই ঢুকে পড়লাম। অত বড় কার্ডটা গলায় ঝুলতে দেখে আর কেউ ফিরেও তাকায়নি! সোজা লিফটে এবং রুফটপ। এলাহি কাণ্ড। গান বাজছে, স্টেজ তৈরি। পানপাত্রে চলকে যায় সন্ধে। ব্রাজিলের সুগন্ধিত-সুন্দরীদের প্রথম দেখা, অত সামনে থেকে। সাংবাদিক, ক্যামেরাওম্যান-রাও এমন ডাকসাইটে সুন্দরী!

হঠাৎ গুঞ্জন। কাফু ঢুকলেন। তিনটে বিশ্বকাপ ফাইনাল, পরপর। ঘরে দুটো বিশ্বকাপ জয়ের ট্রফি। ঠায় দাঁড়িয়ে আছি, যদি সুযোগ পাই ভিড়টা কাটলে। পাওয়া গেল আধঘন্টা পর। সবাই গিয়ে সেলফিনিচ্ছে, আমরা ছবিই তুললাম। কথা বলতে যেতেই, ‘নো ইংলেস’, ‘নো ইংলেস। অতঃপর, দুপাশে দু্ই বঙ্গসন্তান, মাঝে কাফু, থাকলাম খানিকক্ষণ। অনেকক্ষণ বললেই ঠিক। নির্ধারিত সময় পার। কাউকে জিগ্যেস করে যে জানব, তিনি আসবেন কখন, উপায় নেই। প্রায় সবাই নো ইংলেসদলে। ঘন্টা দেড়েক কেটে গেল। কলকাতার মতো কোনও কোনও খুব পরিচিত সাংবাদিক তো বার তিনেক নিয়ে ফেললেন কাফুর বাইট! একবর্ণও বুঝিনি তো কী, আমি আর ধীমান মাঠ ছেড়ে, মানে কাফুকে ছেড়ে, পালাইনি। দুপাশে মনোরঞ্জন আর সুব্রত ভট্টাচার্যের মতো, দুই বাঙালির ‘ক্লোজ মার্কিং’-এ কাফু!

আবার একটা হইচই এবং কাফু হঠাৎ একা। কলকাতা থাকাকালীনই বহু বিজ্ঞ বাঙালির মুখে শুনেছিলাম, পেলেকে নাকি ব্রাজিলে কেউ দেখতেই পারে না! চোখের সামনে দেখলাম, কাফু স্রেফ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন, ৭৪-বছর বয়সী কেউ কীভাবে তাঁর জামানত বাজেয়াপ্ত করছেন, তখনও। আমরাও দৌড়লাম, বাধ্য। নীল স্যুট, সাদা জামা, হলদে-কালো টাই, কুচকুচে কালো চুলের চিরসবুজ সম্রাট ততক্ষণে আসরে!

ক্যামেরার ভিড় ঠেলে গুটি গুটি পায়ে একেবারে সামনে। নিজের হাতেও ক্যামেরা। পরপর ছবি তুলছি, পাগলের মতোই। দেড়হাত দূরে ঈশ্বর! ফুটবল শব্দটাই তো জানা তাঁর সৌজন্যে। খেলতে দেখিনি, প্রশ্নই ছিল না। কলকাতায় সাতাত্তরে যখন এসেছিলেন, বয়স সাড়ে সাত। শুধু বাঁশি শুনেছি-র মতো, কিংবা বিজ্ঞাপন, সির্ফ নাম হি কাফি হ্যায়। ওই নামেই ফুটবল, ওই নামেই ব্রাজিল, ওই নামেই আকর্ষণ। কোথায় ইউটিউব তখন! বয়সে বেড়ে বইতে পড়া, ছবি দেখা। অমোঘ টান! বিশ্ব ক্রীড়াজগতে সবচেয়ে পরিচিত এবং ভালবাসার নাম!

মিড-ডে, সেই স্টোরি-র লিংক - https://www.mid-day.com/articles/brazil-has-no-obligation-to-win-the-world-cup-pele/15366192

পর্তুগিজ পত্রিকার ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশিত হল। তারপর, নানা প্রশ্ন। কাফুর মতো নো ইংলেসবলেননি, গোটা তিনেক প্রশ্ন ইরেজিতেই, উত্তরও এল ইংরেজিতে। বাকিগুলো একবর্ণও বুঝিনি। শেষ হতে খ্যাপার মতো পরশপাথরের সন্ধান, ল্যাপটপের দিকে নজর রেখে, ঘুরে-ঘুরে। ইংরেজিতে লিখছেন নাকি কেউ। এদিকে আয়, পেয়েছিধীমানের স্বর তখন লতা মঙ্গেশকারের চেয়েও মধুর!

সেই সাংবাদিকের নামটা ভুলে গিয়েছি। ঝড়ের বেগে টাইপ করছিলেন। মাঝেই থামালাম, আমাদের আর্জি সকাতর। ‘যদি বলে দেন ইংরেজিতে, কী বলে গেলেন পেলে এবং কাফু’। দুবার তাকালেন। সুভদ্র মানুষ, সময় চেয়ে নিলেন মিনিট পনের। ‘আমি লেখাটা পাঠিয়ে দিয়েই আপনাদের বলে দিচ্ছি সব।’

আশ্বস্ত আমরা পেলাম অন্যদিকে তাকানোর ফুরসত। যতক্ষণ তিনি ছিলেন, অন্যদিকে, এমনকি কাফুর দিকেও ফিরে তাকাননি কেউ। ব্রাজিল যে পাঁচবার বিশ্বজয়ী, ওই দুজনের ঘরে সেই পাঁচটা ট্রফির প্রতিরূপ আছে! এমনকি, টানা তিনবার বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলার কৃতিত্ব পেলেরও নেই। তবু, কাফু যেন ততক্ষণ তৃতীয় শ্রেণীর হিন্দি ছবির পার্শ্বনায়ক। পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন, সঙ্কুচিত। গলা উঠছে না। ভাবখানা, ‘উনি থাকতে আমাকে কেন’!

সময়ের সদ্ব্যবহারে ডিনার হাতে আমরা ঘুরঘুর করছিলাম সেই সাংবাদিকের পেছনে। অন্তত নজরের বাইরে যেন যেতে না পারেন। অবশেষে উঠলেন। আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসি এবার চওড়া, ‘প্লেটটা নিয়ে আসি, খেতে খেতে কথা হবে?’ আমরা প্লেট নামিয়ে নোটবই কলম নিয়ে রেডি ততক্ষণে। 

তখন কি আর জানতাম যে, বিশ্বকাপে পরের ৪১ দিনে আর কখনও দেখা পাব না পেলের? আসবেনই না আর বিশ্বকাপের ধারেকাছেসাহস করে প্রথম রাতেই সই চেয়ে নিতাম তা হলে, নির্লজ্জ। হাতের এত কাছে, এই কলকাতাতেই তো পাব না তাঁকে, কখনও।

কিন্তু, পরে মনে পড়েছিল, ঈশ্বরের কি সই হয়, নেওয়া যায়?