কাশীনাথ ভট্টাচার্য
অমৃতবাজার পত্রিকা, ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৫ |
‘বিশ্বাসঘাতক’ নারায়ণ
সান্যালের সঙ্গে প্রথম পরিচয় বীরপাড়ার জুবিলি ক্লাব লাইব্রেরিতে, বন্ধু টুকাইয়ের (অভিজিৎ
ঘোষদস্তিদার) সৌজন্যে। জলপাইগুড়ি থেকে জোরালো চিঠি-নির্দেশ, পড়তেই হবে। না-পড়লে পিছিয়ে
পড়ব, এতটা বলেনি! কিন্তু, পড়ে ফেললাম এবং ‘ফিদা’। আমি তখন দশম শ্রেণী, আমি তখন ফুলপ্যান্ট!
এগারয় আলাপ প্যারাবোলার
সঙ্গে, প্যারাবোলা-স্যরের সঙ্গেও। ‘ঋণাত্মক রাত’ কী করে ‘ধনাত্মক দিন’-এর দিকে এগিয়ে
যায়, বা ছবিতে মালা ঝোলে প্যারাবোলা-র আকৃতিতে ইত্যাদি। কী করে বিয়ের পর মানুষের জীবন
বৃত্ত (সার্কেল) থেকে চেপ্টে উপবৃত্ত (ইলিপ্স)
হয়ে যায়, একটি কেন্দ্র থেকে দুটি ‘কেন্দ্রবিন্দু’-তে স্থানান্তরিত (যাঁরা আঁক কষেছেন
বারো ক্লাসে, সমীকরণে বুঝতে পারবেন হয়ত, x2 + y2 = a2
থেকে x2/a2 + y2/b2 = 1), তখন নিজের বোঝার
ক্ষমতা ছিল না, কিন্তু, মনে থেকে গিয়েছিল অঙ্ক দিয়ে জীবনকে বোঝানোর সহজ উপায়। ততদিনে
আমি পুরোপুরি সান্যালবাবুর জালে। মুখস্থ করছি, অঙ্কের ফর্মূলার মতো। ইনটিগ্রেশন বাই
পার্টস-এ হাবুডুবু খেতে খেতেও আঁকড়ে ধরছি সান্যালবাবুর বই।
অঙ্ক নিয়ে খানিকটা
পাগলামি ছিল আমারও, অস্বীকার করছি না। তবে, খবরের কাগজের পাতায়ও অঙ্ক কষব, সেই প্যারাবোলা
নিয়ে, চাকরি জীবনের শুরুতে কখনও ভাবিনি এমন!
বাধ্য হয়েছিলাম ১৯৯৫
সালে। তখন যুগান্তর স্পোর্টসে চাকরি। কয়েক মাস পরেই ১৯৯৬ ক্রিকেট বিশ্বকাপ। আমাদের
দেশের সঙ্গে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা জুড়ে খেলা। তিন দেশের নামের আদ্যক্ষর নিয়ে তৈরি
‘পিলকম’ (পাকিস্তান-ইন্ডিয়া-লঙ্কা কমিটি) দায়িত্বে। আহ্বায়ক ছিলেন জগমোহন ডালমিয়া।
সন্ধেয় সিএবি ঘোরা নিয়ম। অফিস থেকেই নির্দেশ, ‘স্টোরি’ করতে হবে।
‘স্টোরি’ খুব বেশি
হয় না আমার, অক্ষমতায়। একে তো আনকোরা, বছরদুয়েক হয়েছে সবে। ট্রেনি থেকে সবে উত্তরণ।
আমাকে চেনেনই বা কে যে ‘স্টোরি’ দেবেন? সিএবি-তে তখন চাঁদের হাট। চিত্রক মিত্র, প্রবীর
মুখার্জি, গৌতম দাশগুপ্তরা আছেন। সদ্য-পরিচিতের জন্য স্টোরি তাঁদের থেকে পাওয়া যায়
না। কেনই বা দেবেন, কোন যোগ্যতা ছিল আমার? জগুদা-র (ডালমিয়া) ঘরে ঢুকে একেবারে পেছনের
সারিতে চুপ করে বসে থাকি, যা বলেন শুনি আর এসে লিখে ফেলি, ব্যস্।
সেই সময় এক দিন ফোন
পেলাম স্কটিশের পরিচিত এক দাদা-কাম-বন্ধুর। ওঁদের সংস্থায় স্পোর্টস কুইজ আয়োজন করতে
চাইছেন। যেহেতু আয়োজক, উনি কুইজ মাস্টার হতে পারবেন না। আমাকে সেই দায়িত্ব নিতে হবে।
আমাদের স্কটিশ-যোগ বরাবরের। তাই নির্দিষ্ট দিনে হাতে একতাড়া প্রশ্ন নিয়ে হাজির সেই
ঝাঁ চকচকে অফিসে।
যুগান্তর, ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৯৫ |
ওখানে একটা প্রশ্ন
করেছিলাম, যত দূর মনে পড়ে, বিরানব্বই বিশ্বকাপে ‘রেইন-রুল’, যা তুমুল বিতর্কের ঢেউ
তুলেছিল ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে, কার মস্তিষ্কপ্রসূত?
এই প্রজন্মের জন্য
বিশদেই বলি যাঁরা তখন খেলা দেখার বা সেই বিতর্কে ঢোকার সুযোগ পাননি। নিয়মটি তৈরি করেছিলেন
সর্বশ্রী রিচি বেনো। অস্ট্রেলীয় বেনো ক্রিকেটার হিসাবে যেমন, পরে ধারাভাষ্যকার হিসাবেও
সর্বোচ্চ শ্রেণীতে।
এমনিতেও আমার ক্রিকেটজ্ঞান
সীমিতর চেয়েও অনেকটা কম। কিন্তু নিয়মটা আমার সেই দিন থেকেই অপছন্দ যে দিন মহম্মদ আজহারউদ্দিনের
দুর্ধর্ষ একটা ইনিংস (৯০-পেরনো, ৯১-৯২ হবে বোধহয়, ক্রিকইনফো দেখলাম না আর!) মাঠে মারা
গিয়েছিল, অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে, ওই নিয়মের জাঁতাকলে, সেই দিন থেকে। তখন থেকেই নিয়মটার
নাম দিয়েছিলাম ‘বেনোজল’, ক্রিকেটার-ধারাভাষ্যকার বেনোকে মাথায় রেখেই।
নিয়মটা কী ছিল? বৃষ্টির
কারণে যদি পরে ব্যাট-করা দলের ওভার সংখ্যা কমে যায়, নতুন ‘টার্গেট’ তৈরি হবে আগে ব্যাট-করা
দলের খেলা সবচেয়ে কম রানের ওভারগুলো বাদ দিয়ে। এভাবে বললে বোঝাতে অসুবিধা হতে পারে।
ধরুন, আগে ব্যাট করে কোনও দল ২৫৭ রান তুলল। বিপক্ষকে জিততে হলে তুলতে হবে ২৫৮, সহজ।
কিন্তু বিপক্ষ ব্যাট করতে নামার পর, ইনিংসের মাঝে বৃষ্টি এল ঝেঁপে। বাদ গেল পাঁচ ওভার।
তখন দেখা হবে, প্রথমে ব্যাট-করা দল সবচেয়ে কম রান তুলেছে কোন কোন ওভারে? দেখা গেল,
ইনিংসের তৃতীয় ও সপ্তম ওভার মেডেন ছিল, ১৬ ও ৩১তম ওভারে একটি করে রান উঠেছিল, ২৭তম
ওভারে দুই। অর্থাৎ, ইনিংস থেকে পাঁচ ওভার বাদ গেল, ‘টার্গেট’ কমল মাত্র চার রান। জিততে
হলে বিপক্ষকে তখন ২৫৮-৪ = ২৫৪ রান তুলতে হবে, পাঁচ ওভার কম খেলে!
সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের
বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার এক বলে ২২ রানের অবাস্তব ‘লক্ষ্য’ তো সবারই মনে আছে,অস্ট্রেলিয়ার
বিরুদ্ধে ভারতের ওই একই সমস্যা হয়েছিল। বৃষ্টির পর তিন ওভার কমে গিয়েছিল। ‘ভিলেন’ হয়ে
গিয়েছিলেন কপিলদেব নিখাঞ্জ নামের এক ব্যক্তি। নিজের কোটার দশ ওভারে দুটি মেডেন নিয়েছিলেন
তিনি, একটিতে দিয়েছিলেন মাত্র এক রান। ফলে, ভারতের কোটা থেকে যখন তিন ওভার কমে গিয়েছিল,
লক্ষ্য কমেছিল মাত্র এক রান!
সেমিফাইনালের বহু
আগে, সেই গ্রুপ লিগের ম্যাচের সময়ই মনে হয়েছিল, একদিনের ক্রিকেটে ‘মেডেন’ নেওয়া যখন
বিশেষ কৃতিত্ব, কেন তার এভাবে অবমূল্যায়ণ হচ্ছে? বৃষ্টি এলেই মেডেন নেওয়া বোলার ভয়ে
কাঁপছেন যেন, ‘এই রে আমার দিকে এবার আঙুল উঠবে, আমি তো একটা ওভারে একটাও রান দিইনি!’
তো, সেই দিন সেই কুইজের
শেষে সেই দাদা-কাম-বন্ধু জানতে চেয়েছিলেন আমার কাছে, ‘এবারের বিশ্বকাপে নতুন যে প্যারাবোলা-পদ্ধতিতে
টার্গেট বেছে নেওয়া হবে, জানিস তো?’ আমি একেবারেই আকাশ থেকে পড়ি। কোনও কাগজে তো পড়িওনি।
ওয়েবসাইট বা চ্যানেল তখনও জন্মায়নি। জানতে চাইলাম। শোনা গেল, এমনই হতে চলেছে প্লেয়িং
কন্ডিশনে। সেই দাদা সেটা দেখেছেন, ডকুমেন্ট আছে তাঁর কাছে। হাতেপায়ে ধরে ফেলি প্রায়।
পরের দিনই সোজা তাঁর বাড়ি। ‘কপি’ করিয়ে রেখেছিলেন, আর বারবার বলেছিলেন, তাঁর নাম যেন
কোথাও না থাকে। আমি এখনও গোপনই রাখলাম, এই ২৫ বছর পরও!
মুশকিল হল স্টোরিটা
লিখে ফেলার পর। তখন যুগান্তর-এ কম্পিউটার ছিল। কিন্তু খটোমটো কম্পোজ-এ সমস্যা। যেমন
ধরুন ইংরেজিতে x2 কীভাবে লেখা হবে? ‘মাইক্রোসফট ওয়ার্ড’ তখনও আজকের মতো
নয়। যে ছবিটা ছিল সঙ্গে সেখানে আবার ইংরেজিতে লেখা। বাংলা কাগজে সেগুলো কী করে দেওয়া
হবে? ছবিটাই বা কী করে আঁকা হবে? যুগান্তর-এ প্রকাশিত লেখায় দেখতে পাবেন, যে ছবিটা
ছাপা হয়েছিল, আদৌ তা ‘প্যারাবোলা’ নয়। পাশে আমাকে বসিয়ে যিনি মাউস ধরে ধরে এতটা কাছাকাছি
এঁকেছিলেন, মনে নেই, ক্ষমাপ্রার্থনায় আন্তরিক আমি। কিন্তু তারও আগে এটা নিয়েই তর্ক
ছিল, স্টোরিটা কি আদৌ ছাপা হবে? ছাপার যোগ্য? খেলার পাতায় এই সব অঙ্কের আঁকিবুকি কি
পাঠক পড়বেন? এতটা জায়গা নষ্ট করা কি উচিত হবে?
সন্ধেবেলায় যখন স্টোরি
নিয়ে এমন আলাপ চলছে যুগান্তর ডেস্কে, আমি যথারীতি এপাশ-ওপাশ ঘুরছি। আমাদের খেলার দায়িত্বে
তখন শান্তিপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়, অমৃতবাজার পত্রিকায় গৌরীশঙ্কর মিত্র, সবচেয়ে সিনিয়র
হিসাবে। স্পোর্টস এডিটর বলতে যাঁকে বোঝায়, যদ্দূর মনে পড়ছে, কেউ ছিলেন না। কিছু দিন
আগেই এক লম্বা-সুদর্শন ছেলে এসেছিল অমৃতবাজারে। অমিতাভ দাসশর্মা। এখন যে দ্য হিন্দু-র
প্রতিনিধি। অমিতাভ-র নাম এখন বদলে হয়ে গিয়েছে ‘এডিএস’, তখন আমরা অমিতাভই বলতাম। দুজনে
দাঁড়িয়ে সিগারেট সহযোগে গপ্পো করছি, ওকে বলেই ফেলি, স্টোরি-টার কথা। একই সঙ্গে অনুরোধও,
ইংরেজিতে যদি নেওয়া যায়।
কথা বলে ফেলেছিল গৌরীদার
সঙ্গে। বাংলাটা যত বড় লেখা হয়েছিল ইংরেজিতে, ছোট করতে বলেছিলেন গৌরীদা। এবার সমস্যা
আমার। ইংরেজিতে লিখব? ভুলভাল লিখব তো! আবার সেই অমিতাভকে পাকড়াও করি। নির্ভরতা দেয়,
‘তুমি লিখে ফ্যালো, আমি দেখে নিচ্ছি’। অগত্যা আমি লাইব্রেরিতে গিয়ে ইংরেজি লিখতে বসি
খাতা-পেন নিয়ে। তখনও আমরা লেখার জন্য নিউজপ্রিন্টের প্যাডগুলোই ব্যবহার করতাম।
লিখে নিয়ে গেলাম অমিতাভর
কাছে। পরীক্ষাপত্রের মতো টেনশন। পড়ল পুরোটা, বলল, ‘ঠিকই তো আছে, চিন্তু করছ কেন? হয়ত
আর একটু ছোট করতে হতে পারে, ওটা আমি করে নিচ্ছি, তোমাকে দেখিয়ে নেব।’ নিশ্চিন্তে এবার
যুগান্তর স্পোর্টস ডেস্কে আবার।
ততক্ষণে সিদ্ধান্ত
হয়ে গিয়েছিল, বাংলায় পুরোটাই যাবে, খেলার পাতায় ‘লিড’। কোনও ‘অফিসিয়াল কোট’ ছাড়াই স্টোরি,
শুধু আমার কথায় ভরসা রেখে - ভাল লেগেছিল, অস্বীকার করব কেন? একই সঙ্গে আবার ইংরেজিতেও
খেলার পাতায় ‘অ্যাঙ্কর’। একই স্টোরি, একই সংস্থার দুটি ভিন্নভাষার কাগজে, একই দিনে
বেরচ্ছে – ভাল লাগারই তো কথা!
ইংরেজি কাগজে প্রথম
‘বাইলাইন’ - ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৫।
***
কয়েক মাস পর ছিয়ানব্বইয়ের
ফেব্রুয়ারিতে বেরল সেই বহু প্রতীক্ষিত বিশ্বকাপের
‘প্লেয়িং কন্ডিশন’ নিয়ে ছোট বই। জগুদার ঘরে আমরা, হাতে-হাতে পৌঁছল সবারই। বইটা পেয়েই
পেছনের দিকে। মাস পাঁচেকের চাপা টেনশন উড়ে গেল যখন দেখলাম সত্যিই সেই প্যারাবোলা-পদ্ধতি
আছে, যা আঁক কষে দেখিয়ে দিয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার এক সতের বছরের ছাত্র ওয়েন ডো রেগো,
আমি যাঁর কথা লিখেছিলাম সেই সেপ্টেম্বরের স্টোরিতে। তত দিনে আমি দলবদলের বাজারে যুগান্তর
ছেড়ে বঙ্গলোক বলে আর একটি কাগজে।
বঙ্গলোক, ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ |
খারাপ লেগেছিল সেই
প্লেয়িং কন্ডিশনে ওয়েনের নাম না-দেখে। সেটাই লিখেছিলাম তখন বঙ্গলোক-এ। রইল সেই লেখাটাও,
১৯৯৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত।
আর, ময়দানে দু-তিনজন
সিনিয়র সাংবাদিক, যাঁদের সঙ্গে নিয়মিত দেখা আর হয় না এখন, বলতেন, ‘তোর সেই খেলার পাতায়
অঙ্ককষাটা কিন্তু মনে আছে এখনও’ – প্রাপ্তি!