Sunday, June 28, 2020

কাশীনাথ ভট্টাচার্য / আপকি ‘সুরোমে’ কুছ মেহকে হুয়েসে রাজ হ্যায়...

২৭ জুন, ১৯৩৯। শচীন–মীরা দেববর্মনের কোল আলো করে এসেছিলেন রাহুল। ‘আর ডি বর্মন: দ্য ম্যান, দ্য মিউজিক’, জন্মদিনের প্রাক্কালে পড়তে পড়তে ‘পঞ্চম্যানিয়া’–য় আক্রান্ত কাশীনাথ ভট্টাচার্য

ভক্তরা ভালবেসে ডাকছেন ‘loRD’!
কেউ আবার বলছেন, ‘আর ডি’ মানে ‘রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ বর্মন!
অনিরুদ্ধ ভট্টাচার্য ও বালাজি ভিত্তল–এর ‘আর ডি বর্মন: দ্য ম্যান, দ্য মিউজিক’ পড়তে গিয়ে মনে হবে দুটোই সত্যি। ভক্তের আকুলতা আছে যেমন, ছাড়িয়ে গিয়েছে গবেষণা। ৩৬৬ পাতার ‘আরডি’ ম্যাজিক, পড়তে পড়তে ভেসে–যাওয়া পাগলপারা সুরদরিয়ায়। সেই ‘সাগর কিনারে’ কখনও মন বলে, ‘তেরে বিনা জিন্দেগিসে কোই সিকওয়া তো নেহি’; কখনও ‘মেরা কুছ সামান তুমহারে পাস পড়া হ্যায়’; কখনও আবার, ‘তেরে লিয়ে পলকো কি ঝালর বুনু’। আর, কিশোর তো চির কুমার তাঁর সুরেই, ‘মুঝে চলতে জানা হ্যায়’!
কিন্তু, ‘আর ডি বর্মন; দ্য ম্যান, দ্য মিউজিক’ পঞ্চমের সুরে পাগল–করা গানের তালিকা ভাবছেন যাঁরা, ভুল ভাবছেন। এখানে পঞ্চম হাজির তাঁর দোষ–গুণ সমেত। সঙ্গেই চলেছে বলিউডের ইতিহাসও। এসডি–আরডি, বাবা–ছেলের গানের কে কোথায় কীভাবে প্রভাব রেখেছেন; আরডি–র বিরুদ্ধে ওঠা চেঁচামেচি বা বিদেশি সুর থেকে প্রভাবিত হওয়ার অভিযোগ এবং প্রভাবিত–হওয়া গানগুলির কথা; প্রথম স্ত্রী রীতা প্যাটেল, আশা ভোঁসলের সঙ্গে সম্পর্ক; স্বপন চক্রবর্তীর বিতর্কিত উপস্থিতি, আছে সব। আর, যা এই বইয়ের সম্পদ, পঞ্চম সুরারোপিত প্রায় সব গানের ‘হয়ে–ওঠা’র কাহিনী। অনিরুদ্ধ–বালাজি কথা বলেছেন সেই সব অবিস্মরণীয় গানের কারিগরদের সঙ্গে, ঢুকে পড়েছেন সেই আঁতুড়ে যেখানে জমে রয়েছে এমন সমস্ত গানের জন্ম–ইতিহাস। পড়তে পড়তে, কোথাও ‘আপনার’ হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা!
‘‘গায়িকা আরতি মুখার্জির মনে পড়ছিল উত্তর কর্ণাটকের ধারওয়াড়ে পণ্ডিত মল্লিকার্জুন মনসুরের সঙ্গে এক সঙ্গীতানুষ্ঠানের অভিজ্ঞতা। পণ্ডিতজি গুনগুন করছিলেন, ‘র‌্যয়না বিতি যায়ে’। তাই দেখে আরতি আশ্চর্য। ক্লাসিক্যাল মিউজিকের এত বড় এক পণ্ডিত লঘুসঙ্গীত গাইছেন! আরতির মুখ দেখে প্রশ্ন বুঝে পণ্ডিতজি জানিয়েছিলেন, এসডি’র ছেলে কী সুন্দরভাবে একের পর এক নোট সাজিয়েছে সেই গানে যে, মানুষ গুনগুন করতে বাধ্য।’’
একই অভিজ্ঞতা ‘চিঙ্গারি কোই ভড়কে’ প্রসঙ্গেও। ‘‘মার্গসঙ্গীতের অনুরাগী অর্চিষ্মান মজুমদার ২০০২ সালে গিয়েছিলেন সঙ্গীত রিসার্চ আকাদেমিতে, পণ্ডিত উল্লাস কাশলকারের সঙ্গে দেখা করতে। সেই কম্পাউন্ডে কোনও এক জায়গা থেকে ভেসে আসছিল, ‘চিঙ্গারি কোই ভড়কে’। কৌতূহলী অর্চিষ্মান হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যান পণ্ডিত এটি কাননের বাংলোয়। তাঁর বিস্মিত প্রশ্নের উত্তরে পণ্ডিত কানন বলেছিলেন, ‘যে কিশোরকুমারকে ভাল না বাসতে পেরেছে আর এমন গানের মর্যাদা না–দিতে পেরেছে সে তো বদ্ধ–পাগল!’’
‘র‌্যয়না বিতি যায়ে’–র সুর–ব্যাখ্যাও করেছেন লেখকেরা। ‘‘টোডি ভোরের রাগ আর খাম্বাজ গভীর রাতের রাগ, পঞ্চম এই দুই রাগ মিশিয়ে এমন একটি সুর সৃষ্টি করলেন সিনেমায় যা গাওয়া হল সন্ধেবেলা! পঞ্চমের ক্ষেত্রে স্বাভাবিকই বটে! পরে, ১৯৯৩ সালে রেডিওতে গুলজার জানিয়েছিলেন, ‘এই গানের বন্দিশে মেজাজটাই আসল, কখন গাওয়া হচ্ছে নয়।’... খামাজ রাগের ভিতের ওপরেই অমর প্রেম ছবিতে পঞ্চম আরও দুটি গান তৈরি করেছিলেন, ‘বড়া নটখট হ্যায় রে’ আর ‘কুছ তো লোগ কহেঙ্গে’। একই রাগের ভিত, কিন্তু, তিনটি গানই কত আলাদা পরস্পর থেকে।’’
পিয়া তু...
পঞ্চম মানে কি শুধু হিন্দি সিনেমার রাগপ্রধান গান? না, পঞ্চম মানে ‘পিয়া তু’, ‘দম মারো দম’, ‘মেহবুবা মেহবুবা’, ‘কাঁটা লগা’–ও!
‘দম মারো দম’ নাকি প্রথমে গাওয়ার কথা ছিল লতা মঙ্গেশকার এবং ঊষা উত্থুপের, জানিয়েছেন ঊষা উত্থুপ নিজেই। লতার গলায় ‘দম মারো দম’ শুনতে কেমন লাগত, সঙ্গীতপ্রেমীদের ভেবে দেখার বিষয়। পরে সিদ্ধান্ত পাল্টেছিলেন আরডি। ঊষা বলেছেন, ‘‘পঞ্চমদা দুঃখপ্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘ইয়ার কুছ করতে হ্যায়’। মাথায় আরও একটি গান ছিল তাঁর।’’ একই ছবিতে, ‘আই লাভ ইউ’। আর, ‘আশার কণ্ঠে সেই গান (‌দম মারো দম)‌ হয়ে উঠেছিল হিপি–প্রজন্মের জাতীয় সঙ্গীত’, লিখেছেন অনিরুদ্ধ–বালাজি।
আশা–আরডি ডুয়েট মানেই ‘পিয়া তু’। ‘কারওয়াঁ’ (‌বাঙালি অবশ্য ‘ক্যারাভান’ বলতেই বেশি অভ্যস্ত!)‌ ছবিতে, অনিরুদ্ধ–বালাজির কথায়, ‘হেক্সাটনিক ব্লুজ স্কেলে এই গান ছিল প্রথাগত গানের বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদ। বাধা–বন্ধনহীন কামনার আগুন। গানটা শুরু হয় তুলনামূলক ধীরগতিতে, টেনর স্যাক্সে, চরণজিৎ সিংয়ের বাস গিটার, বুর্জোর লর্ডের ভাইব্রাফোন এবং পিয়ানোতে ঘড়িতে বারোটা বাজার শব্দে। লয় বেড়ে যায় হঠাৎ, কেরসি লর্ডের কী–বোর্ড আর জর্জ ফার্নান্ডেজের ট্রাম্পেটে, শুরুর সঙ্গে যার কোনও সম্পর্কই খুঁজে পাওয়া যায় না। পঞ্চমের ‘সিগনেচার’, যা এই গানের পরেও পাওয়া যাবে বহু গানে।’ ‘মনিকা’ ডাক, ভোলা যায়?
‘মেহবুবা মেহবুবা’ ঘিরে স্মৃতির সরণিতে হেঁটেছেন রণধীর কাপুর। ‘এক দিন পঞ্চমের বাড়িতে ঢুকে অবাক। পঞ্চম নিজে তো বটেই, ওর সহকারীরাও দেখি অর্ধেক–ফাঁকা বিয়ারের বোতলে ফুঁ দিয়ে যাচ্ছে। আমি তো ভাবলাম, সবাই বদ্ধ–মাতাল! যাই হোক, জিজ্ঞেস করলাম পঞ্চমকেই, ব্যাপারটা কী? বলল, নতুন ধরনের একটা সাউন্ড চাইছে, ঠিক কেমন হবে বোঝার জন্যই এই খেলা। বুঝুন! পরে দেখা গেল, ‘মেহবুবা মেহবুবা’–র শুরুতে যে শব্দ আপনারা শোনেন, সেই শব্দের উৎস সন্ধানেই ছিল সেদিনের সেই বিয়ারের বোতলে প্রাণপণে ফুঁ দেওয়ার খেলা। পঞ্চমের পক্ষেই সম্ভব!’
লতা–আশা
কী করে বেছে নিতেন পঞ্চম? মানে, কোন গানটা লতাকে দেবেন আর কোন গানটা আশাকে?
‘ডন ব্র‌্যাডম্যান আর গ্যারি সোবার্সের মধ্যে কে বড় বেছে নেওয়া যায় নাকি’, বলেছিলেন পঞ্চম। সত্যিই তো! কিন্তু, বেছে নিতেন পঞ্চম, এবং তাঁর সেই বাছাই নিয়ে প্রশ্ন নেই। ‘ঝিল কে উস পার’ ভাবুন। লতার গলায় ‘দো ঘুঁট মুঝে ভি পিলা দে শরাবি’ ও আশার গলায় ‘হায় বিছুয়া ডস্‌ গয়ো রে’। গানের লয় অনুসরণে সাধারণ আমাদের মনে হতেই পারে যে ‘দো ঘুঁট’ প্রাপ্য ছিল আশারই। কিন্তু, তিনি অন্যরকম ভাবতেন বলেই তো মৃত্যুর ১৭ বছর পরেও তাঁকে ঘিরে এত আগ্রহ।
‘দিদিকে ভাল ভাল গান দিতেন’ আশার এমন অভিযোগও সুবিদিত। কঠিন কঠিন গানগুলো নাকি তাঁর জন্যই রেখে দিতেন পঞ্চম, বলেছিলেন। যেমন, আশার কথায় ‘কারওয়াঁ’–য় ‘দাইয়া ইয়ে ম্যাঁয় কাঁহা আ ফাসি’–র মতো কঠিন গান কমই করেছেন তিনি। অথচ, ‘কারওয়াঁ’–তেই ছিল ‘পিয়া তু’, যে–কারণে আশা মনে করেন, ‘দাইয়া’ প্রাপ্য জনপ্রিয়তা পায়নি। এমনকি, আরডি–র যে–গান শুনে শাম্মি কাপুর বলেছিলেন, ‘ভবিষ্যতে ট্রেন্ডসেটার হয়ে যাবে’, সেই ‘আজা আজা ম্যাঁয় হুঁ প্যার তেরা’–র ক্ষেত্রে পঞ্চম নিজেই জানিয়েছিলেন, দিদি লতার সাহায্য নিতে হয়েছিল আশাকে। এবং, গানটি পঞ্চমের ‘ওকে’ পেয়েছিল তৃতীয় ‘টেক’–এ, জানিয়েছেন স্বয়ং আশা।
তবু, একবারই স্বীকারোক্তি করেছিলেন পঞ্চম। ২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৫, টাইমস অব ইন্ডিয়াকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে। ‘লতাজির শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে সন্দেহের কণাও থাকতে পারে না। যখন গান করেন, সব ভুলে যান। নিজের বাড়ি, এমনকি নিজেকেও; সম্পূর্ণ অন্য এক সত্তা যেন জেগে ওঠে তখন। জিজ্ঞেস করলে মানতে চাইবেন না হয়ত, কিন্তু মাইক্রোফোনের সামনে তিনি কখনও মা, কখনও প্রেমিকা।’
আসলে, কাকে দিয়ে গাওয়াবেন প্রসঙ্গে দুটি গানের কথা মনে করতে পারেন পঞ্চম–প্রেমী। কুদরতে রাগাশ্রয়ী ‘হমে তুমসে প্যার কিতনা’ আর বাংলায় কলঙ্কিনী কঙ্কাবতীতে ‘বেঁধেছি বীণা গান শোনাব তোমায়’। একটি গানে কিশোর ছিলেন, অন্যটির হিন্দি ‘এ রি পবন’–এ লতা। তবুও, সাধারণ মানুষ, মার্গসঙ্গীতে যাঁদের বিচরণ কম, মনে রেখে দিয়েছেন পরভিন সুলতানাকে, লঘুসঙ্গীতের এই দুটি অমর সৃষ্টির কারণেই।
এর পর আর প্রশ্ন চলে?
তথ্যের আলোয়
রাজীব গান্ধী, সিনেমায়? আজ্ঞে, হ্যাঁ! ‘বম্বে টু গোয়া’–য় অমিতাভ বচ্চন যে–ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সেই ‘রোল’ অমিতাভের আগে ‘অফার’ করা হয়েছিল ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে। মেহমুদ দিয়েছিলেন প্রস্তাব। তিনি ‘না’ বলার পর সুযোগ এসেছিল অমিতাভের কাছে। তিয়াত্তরে ‘জঞ্জীর’–এর আগে অমিতাভের একমাত্র ‘হিট’ ছবি।
‘ও হংসিনী’ মানেই কিশোর কুমার মনে পড়বেন। কিন্তু, ‘জহরিলা ইনসান’–এর নায়ক ঋষি কাপুরের একেবারেই না–পসন্দ। ‘ববি’–র পর ঋষি কাপুরের গলায় শৈলেন্দ্র সিং ছাড়া আর কাউকে ভাবা যায়? ঋষির স্বীকারোক্তি, ‘চেয়েছিলাম শৈলেন্দ্রকেই। পঞ্চমের ইগো বা যা–ই হোক না কেন, কিশোরকুমারকে দিয়েই গাওয়াবেন, জানিয়েছিলেন। খুব একটা নিশ্চিত ছিলাম না, কেমন হবে। কিন্তু, পরে বুঝেছি, কী অসাধারণ।’ ‘জহরিলা ইনসান’ নামে একটি ছবি হয়েছিল, মানুষ ভুলে গিয়েছেন। কিন্তু পঞ্চম–কিশোর যুগলবন্দীর অন্যতম সেরা নমুনা হিসেবে থেকে গিয়েছে ‘ও হংসিনী’, এখনও ঘুরছে লোকের মুখে মুখে!
‘পড়োশন’ ছবিতে কিশোর–মান্নার অমর–ডুয়েট ‘এক চতুর নর’। মান্না দে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন, আশাহতও, কারণ জানতেন যে, শেষে তিনি যাঁর জন্য প্লে–ব্যাক করছেন সেই মেহমুদকে হেরে যেতে হবে কিশোরকুমারের কাছে। কিশোরও বরাদ্দ রেখেছিলেন তাঁর সেরা চমক। গানের মধ্যে এক জায়গায় হঠাৎ গেয়ে ওঠেন, ‘ও টেরে, সিধে হো যা রে’। গানের মধ্যে যা আদৌ ছিল না। ‘লাইভ রেকর্ডিং’, কিশোর ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ভেবে, গেয়েও ফেলেছিলেন! মান্না হতবাক, রেকর্ডিং রুমের কাচের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা পঞ্চমের দিকে ইশারায় বলতে চেয়েছিলেন বোধহয়, ‘এটা কী হল?’ কিন্তু, এত ভাল লেগেছিল আরডি–র যে, হাতের ইশারায় গান চালিয়ে যেতে বলেছিলেন মান্না দে–কে। থেকে গিয়েছেন তাৎক্ষণিক কিশোর। ঠিক যেমন গুলজারও পাল্টাতে চাননি ‘আপকি আঁখোমে কুছ’ গানের অন্তরায় কিশোর–কণ্ঠের ‘লব হিলে...’। গুলজার লিখেছিলেন ‘জব’ হিলে। রেকর্ডিং এত ভাল হয়েছিল, পঞ্চম পাল্টাননি। থেকে গিয়েছে, থেকে যায়, ইতিহাস!
প্রায়শ্চিত্ত!
অমর প্রেম, হরে রাম হরে কৃষ্ণ (‌একই সময়ে এই দুটি ছবির সুর করছিলেন আর ডি, ভাবা যায়!)‌, তিসরি মঞ্জিল, পড়োশন, কটি পতঙ্গ, আঁধি, মেহবুবা, ইয়াদোঁ কি বরাত, কারওয়াঁ, হম কিসিসে কম নেহি, মেরে জীবন সাথী, কুদরত যা পায়নি, পেল কিনা সনম তেরি কসম!
ফিল্মফেয়ার পুরস্কার, সুরকার হিসেবে নিজের রজত জয়ন্তী বছরে (‌প্রথম গান ‘অ্যায় মেরে টোপি পালটকে আ’, ১৯৫৬, ফান্টুস ছবিতে)‌ প্রথম বার উঠেছিল পঞ্চমের হাতে। লেখকরা জানিয়েছেন, ছবির প্রযোজক বরখা রায় এক টিভি–সাক্ষাৎকারে পরে বলেছিলেন, পঞ্চম নিজে নিশ্চিত ছিলেন না। আগে আরও অনেক ছবিতে দুর্দান্ত সুর করেও পাননি বলে। তিরাশি সালে মুম্বইয়ের ‘মিড ডে’ পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকার থেকে আর ডি–র বক্তব্যও তুলে ধরেছেন অনিরুদ্ধ–বালাজি। ‘সত্যিই আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। নিজেকে সান্ত্বনা দিতাম এই বলে যে, পুরস্কার নয়, মানুষের কাছে যে–সম্মান পেয়েছি, তাই–ই আসল। ভক্তরাই ছিলেন আমার পুরস্কার। সনম তেরি কসম সুরকার হিসেবে আমার সেরা ছবিগুলোর মধ্যে পড়ে না। খুব বেশি হলে ‘ইলেকট্রনিক ফ্রেঞ্জি’ বলা যায়। তবুও, যখন জানতে পারি পুরস্কার পাচ্ছি, খুব আনন্দ হয়েছিল। সে–রাতে কেঁদেও ফেলেছিলাম, আনন্দে।’
অনিরুদ্ধ–বালাজি অবশ্য জানাতে ভোলেননি, সেই একই বছরে খৈয়াম–এর ‘বাজার’–ও ছিল ফিল্মফেয়ার–এর ‘নমিনেশন’ তালিকায় এবং হয়ত ‘সনম তেরি কসম’–এর তুলনায় এগিয়েও ছিল। কিন্তু, মনে করিয়ে দিয়েছেন, ছ’বছর আগে সেই খৈয়াম–এর ‘কভি কভি’–র কাছে হারতে হয়েছিল আর ডি–র ‘মেহবুবা’–কে!
পরের বছরই ‘মাসুম’ এবং শেষে ‘১৯৪২: এ লাভ স্টোরি’; মোট তিনবার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পেয়েছিলেন পঞ্চম। ‘১৯৪২’–এর সময় অবশ্য তিনি প্রয়াত। তাঁর চেয়ে অনেক অনেক বেশিবার এই পুরস্কার যাঁরা পেয়েছিলেন তাঁদের কারও নামে ফিল্মফেয়ার কর্তৃপক্ষ কোনও পুরস্কার চালু করেনি কিন্তু। ‘আর ডি বর্মন অ্যাওয়ার্ড ফর নিউ মিউজিক ট্যালেন্ট’ ফিল্মফেয়ারের একমাত্র পুরস্কার যা কোনও বিশেষ ব্যক্তির নামে উৎসর্গ করা হয়েছে। ফিল্মফেয়ার–এর প্রায়শ্চিত্ত!

শুরু ও শেষ
শুরুতে ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন শাম্মি কাপুর। ‘তিসরি মঞ্জিল’–এর সুরকার হিসেবে আদৌ নেবেন কি দাদা–বর্মনের ‘লেড়কা’–কে?
প্রথম শুনিয়েছিলেন নেপালি গানের একটি লাইন যা পরে হয়ে দাঁড়িয়েছিল ‘দিওয়ানা মুঝসা নেহি’। শাম্মি শুনেই বলেছিলেন, ‘অন্য কিছু শোনাও, এটা আমি জয়কিষাণকে দিয়ে করিয়ে নেব।’ টেনশন কাটাতে আর ডি চলে যান বাইরে, ঘনঘন সিগারেটে টান দিয়ে ফিরে এসে শুনিয়েছিলেন তিনটি গানের সুর — ‘ও মেরে সোনা রো সোনা’ ‘আ আ আজা’ ও ‘ও হাসিনা জুলফোঁওয়ালি’। মাঝপথে থামিয়ে বলে উঠেছিলেন শাম্মি, ‘তুম পাস হো গ্যয়ে, তুমিই আমার মিউজিক ডিরেক্টর!’
শেষ ইন্টারভিউ ১৯৯২–তে। কাজ চলছে ‘১৯৪২: এ লাভ স্টোরি’–র। পরিচালক বিধুবিনোদ চোপড়া তার আগেও কাজ করেছেন পরিন্দা–তে, প্রিয় পঞ্চমদা–র সঙ্গে। গান শুনতে এসেছেন। পঞ্চম শোনালেন একটি সুর। বিধু–র একেবারেই পছন্দ হয়নি। ‘কিচ্ছু হয়নি, কী করছ পঞ্চমদা?’
আগের সাত বছর কষ্টে কেটেছে। ডিস্কো–জমানা, ২৭টি ফ্লপ সিনেমা, মানসিক অবসাদ, পরিচিতদের মুখ–ফিরিয়ে নেওয়া, যে এল–পি’র জন্য দোস্তিতে হারমোনিকা বাজিয়েছিলেন সেই এল–পি রাম লক্ষ্মণে পঞ্চমকে নিলে আর কখনও কাজ করবেন না বলে হুমকি পর্যন্ত দিয়েছিলেন সুভাষ ঘাইকে, ইত্যাদিতে অভ্যস্ত প্রায়–হতাশ পঞ্চম জানতে চেয়েছিলেন, ‘আমিই কি থাকছি তা হলে? সুরকার হিসেবে?’ বিধু–র উত্তর, ‘পঞ্চমদা, তোমার মিউজিক চাই, ইমোশন নয়।’
সাত দিন পর একসঙ্গে আবার। শুধু শুরু করেছিলেন পঞ্চম, সেই একই গানের নতুন সুর। ‘কুছ না কহো’ গেয়ে চোখ তুলে দেখতে পেয়েছিলেন বিধু–র চোখ বন্ধ, তর্জনী মাথার ওপরে!
সাতাশ বছর পরও একই ভাবে পরীক্ষা, একইভাবে পাস! এমনকি, ‘তিসরি মঞ্জিল’ যা দিতে পারেনি তখন ‘নবাগত’ বলে, সেই বাধাও ছিল না ফিল্মফেয়ার কর্তৃপক্ষের কাছে। বিশ্ব বুঝেছিল আরও একবার, বিষাদগ্রস্ত জিনিয়াসও যা করে থাকেন, অভাবনীয়!
‘সময়কা ইয়ে পল’ থমকে গিয়েছিল ১৯৯৪–এর ৪ জানুয়ারি। কিন্তু, থেমে থাকেনি পঞ্চমের সুর। এখনও তাই রিমিক্সে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত তিনি। তাঁকে মাথায় রেখে ছবি হয় ‘ঝংকার বিটস’, তাঁর গান নিয়ে ‘দিল ভিল প্যায়ার ওয়ার’। রিয়েলিটি শো–তে বাচ্চাদের গলাতেও বেজে চলেছেন পঞ্চম, অনবরত। এমনকি, টিভি খুলুন, হাওয়াই চপ্পলের বিজ্ঞাপনেও শুনবেন, ‘আজকাল পাঁও জমি পর নেহি পড়তে মেরে’!
‘বেবজা তারিফ করনা’ অনিরুদ্ধ–বালাজির ‘আদত নেহি’। কিন্তু, ‘আর ডি বর্মন: দ্য ম্যান, দ্য মিউজিক’ মুক্তকণ্ঠে সোচ্চার, ‘কুছ মেহকে হুয়েসে রাজ হ্যায়’, পঞ্চমের সুরে!

                                                                         * আজকাল, রবিবাসর, ২৬ জুন ২০১১