Wednesday, September 30, 2020

কাশীনাথ ভট্টাচার্য / বৈচিত্র্যের রানির রাজপাট বাংলাতেও

বাংলা সিনেমার গানে বোম্বে, তৃতীয় পর্ব – আশা ভোঁসলে

লতা মঙ্গেশকারের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, গায়িকা আশা ভোঁসলে ঠিক কোন কোন দিকে এগিয়ে, ‘স্ট্রং পয়েন্ট’ কী কী?

নাসরিন মুন্নি কবীর-কে বুঝিয়ে বলেছিলেন ‘লতা মঙ্গেশকার ইন হার ওন ভয়েস’ বই-তে ‘দিদি’ লতা – ‘‘বৈচিত্র‌্য। যে কোনও ধরনের গান দিন ওকে, খুব ভাল গেয়ে দেবে। সে দুঃখের গান হোক বা হাসির, রোমান্টিক বা নাচের গান। আমার বোন বলে বলছি না, ওর গুণের কথা বলা তো আমার কর্তব্যও। যত ধরনের গান আশা গেয়েছে, মনে হয় না কারও সঙ্গে ওর তুলনা করা সম্ভব। যখন এসেছিল ইন্ডাস্ট্রিতে, একদম অন্যরকম গাইত। পরে বর্মনদার প্রভাব পড়ে ওর ওপর, নিজেকে আরও এগিযে নিয়ে যায়। বর্মনদার একটা স্টাইল ছিল, গানের কোনও লাইনে একটি কথার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া। যেমন, ‘মেরে বন যাও’–তে যাও’–এর ওপর। বাংলা লোকগীতি থেকে এই স্টাইলটি এনেছিলেন বর্মনদা। ও পি নায়ারও পরে এই স্টাইলটি রপ্ত করেছিলেন। হাওড়া ব্রিজ ছবিতে আশার আইয়ে মেহেরবানগানটা মনে পড়ছে? যেভাবে আইয়েশব্দটার ওপর বিশেষভাবে জোর দিয়েছিল, অনবদ্য। ও পি নায়ারের গানও খুব গাইত আশা। নায়ার সাহেব বরাবরই শামসাদ বেগম, গীতা দত্ত, কিশোর কুমার আর রফি সাহেবকে পছন্দ করতেন, ওঁর সুরে গান গাওয়ার জন্য। মনে করতেন, ওঁর সুর ঠিক আমার গলার জন্য নয়। আমারও বিশ্বাস, ঠিকই করতেন। ওঁর কম্পোজিশনগুলো ঠিক আমার জন্য নয়।’’

তাই বৈচিত্র্যের রানি আশা হিন্দির মতো বাংলাতেও রাজপাট সাজিয়ে বসেছিলেন নিজের মতো করেই। পাঁচের দশকের শেষ দিকে বাংলা ছবিতে আগমন। প্রথম গান, খুঁজে যা পাওয়া যাচ্ছে সালের হিসাবে, সম্ভবত, ‘গলি থেকে রাজপথ’ সিনেমায়, ১৯৫৯ সালে। ‘কে গো তুমি ডাকিলে আমারে’গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায়, সুধীন দাশগুপ্তর সুরে। পরে যে জুটিতে আরও বহু স্মরণীয় গান গাইবেন আশা। আর, পর্দায় সে গান গেয়েছিলেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়।

ছয়ের দশক ছেড়ে দিন, সাতের দশক থেকে কিন্তু প্রায় বছর কুড়ি আশা রাজত্ব করেছেন বাংলা ছবির গানে। আর সেখানে পথিকৃৎ বলা যেতেই পারে সুধীন দাশগুপ্তকে। বড় ভাল ভাল গান গাইয়েছিলেন আশাকে দিয়ে আলাদা করে বলার নেই বাঙালি শ্রোতাকে, কিছু গানের কথাই যথেষ্ট। ডেকে ডেকে চলে গেছি, কোন সে আলোর স্বপ্ন নিয়ে (প্রথম কদম ফুল, ১৯৭০); আমার দিন কাটে না, আরও দূরে চলো যাই (ছদ্মবেশী, ১৯৭১); আজ দুজনে মন্দ হলে (ফরিয়াদ, ১৯৭১); কেন সর্বনাশের নেশা ধরিয়ে, মন মেতেছে (পিকনিক, ১৯৭২); সাগর ডাকে আয় (জীবন সৈকতে, ১৯৭২); আমি অন্ধকারের যাত্রী (এপার ওপার, ১৯৭৩) এর মধ্যে আবার প্রথম কদম ফুল নিয়ে অন্য গল্প শোনা গিয়েছে। সুধীন নাকি চেয়েছিলেন ‘কোন সে আলোর স্বপ্ন নিয়ে’ গাইবেন লতা! দেখা করতেও গিয়েছিলেন লতার সঙ্গে। সেই দিন, কোনও কারণে, ‘দিদি’ ছিলেন না প্রভু কুঞ্জে। ‘বোন’ আশার সঙ্গে কথা হয়, ‘ডেকে ডেকে’ নিয়ে। দিদির কোন গানটা, জানতে চেয়েছিলেন আশা। শুনে নাকি বলেছিলেন, গাইলে দুটি গানই গাইবেন, না হলে একটাও নয়। অগত্যা, কী-ই বা করতে পারতেন আশার ‘সুধীনদা’ তখন!

যদি কানে কানে কিছু বলে বঁধুয়া

বাংলা ছায়াছবিতে আশার জনপ্রিয়তা বেড়ে যাওয়ার অবশ্যই বড় কারণ রাহুল দেব বর্মনকিন্তু তারও আগে শ্যামল মিত্রর নাম নিতেই হবে রাহুল যখন অনুসন্ধান ছবিতে ‘আমার স্বপ্ন যে সত্যি হল আজ’-এ কিশোরসঙ্গী করেছেন লতাকে, শ্যামল কিন্তু তার আগে কিশোরের সঙ্গে আশার ডুয়েট করে ফেলেছেন ‘আমার স্বপ্ন তুমি ওগো চিরদিনের সাথী’ গানে, আনন্দ আশ্রম ছবিতে, ১৯৭৭ সালে। সবচেয়ে বড়, শ্যামল মিত্রর সুরে আশার যেখানে বাংলা ছবিতে অসংখ্য মনভোলানো গান, লতার নেই-ই। সেই ‘নেই সেই পূর্ণিমা রাত’ দিয়ে শুরু। ১৯৭৬ সালে অজস্র ধন্যবাদ ছবির সব গানই ফিরত লোকের মুখে-মুখে। ববি-খ্যাত শৈলেন্দ্র সিংকে নিয়ে এসেছিলেন শ্যামল, ‘নদী যদি বলে সাগরের কাছে আসব না’ যেমন মনে রেখে দিয়েছেন বাঙালি শ্রোতা, আশার ‘প্রেম কথাটাই ছোট’ গানটিও। আলাদা উল্লেখ এই জন্যই যে শ্যামলের নিজের ছায়া ঝরা ভরা সাঁঝে এবং তুমি যে আমারই গান-ও এই একই ছবির, দ্বিতীয় গানটি আবার সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ও গেয়েছিলেন। তারই মাঝে এই দুটি গান এবং আশা-শৈলেন্দ্রর দ্বৈত ‘কাছে আছ তুমি’ আলাদা করে মনে থেকে যাওয়াও বড় সাফল্য।

পরে শ্যামলের সুরে আরও কত গান! জানি না আজ যে আপন, না না না না এমন করে (অমানুষ ১৯৭৫), ভালবেসে ডেকেই দেখো না (আনন্দ আশ্রম, ১৯৭৭); আমি কে সে কি ভুলে গেলে, নেশা তুমি যতই করো (কলঙ্কিনী, ১৯৮১); কুঞ্জবিহারী হে গিরিধারী (মায়ের আশীর্বাদ, ১৯৮২)। জয়যাত্রা শুরু যেন তাঁর হাত ধরেই পরে, একান্ত আপন, ত্রয়ী বা তিনমূর্তি-তে পঞ্চম স্বাভাবিকভাবেই আশা ছাড়া অন্য কারও দিকে তাকাননি

আটের দশকে একটি ছবি এসেছিল, দীপঙ্কর দে ও অপর্ণা সেন জুটিতে, মোহনার দিকে সুরকার ছিলেন আরডি-র একসময়ের সহকারী স্বপন চক্রবর্তী ছবিতে মোট ছটি গান, একটি কিশোর কুমারের, ‘নাই নাই এ আঁধার থেকে ফেরার পথ নাই বাকি পাঁচটি গান আশারআছে গৌর নিতাই নদীয়াতেসব পুজো প্যান্ডেলে যদিমাস্টহয়ে থাকে, ‘কে যেন আবীর ছড়িয়ে দিল ভোরের আকাশেএবংরামধনু রঙ নিয়ে আমি খেলাঘর বেঁধেছি’, গানদুটি শুনলেই মনে হয় সুরারোপ করেছিলেন আরডি স্বয়ং! আর লালকুঠি ছবিতে স্বপন-জগমোহনের সুরেও আশাই, ‘তারে ভোলানো গেল না কিছুতেই’!

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রক্সিতে সবাইকে দিয়েই একটি করে দুরন্ত গান গাইয়েছিলেন। আশার ‘যখন তোমার গানের সরগম’ অন্যতম। বিশেষভাবে মনে করা যেতে পারে ভূপেন হাজারিকার সুরে চামেলি মেমসাহেব ছবিতে ‘কখগঘ চছজঝ এবিসিডি নিয়ে গো’। ছবি ততটা সফল না হলেও কখগঘ-র সাফল্য প্রশ্নাতীত। যেমন, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ও ‘যদি কানে কানে কিছু বলে বঁধুয়া’ গাইয়েছিলেন জীবন রহস্য ছবিতে।

শেষ দিকে আরডি থাকাকালীন এবং আরডি-র পর, বাপি লাহিড়ি বেছে নিয়েছিলেন আশাকে, একই রকম চমকপ্রদ কিছু গানের ক্ষেত্রে। বরাবরই আশা নতুন প্রজন্মের সুরকারদের সঙ্গে সমান স্বচ্ছন্দ্য। এখনও তিনি নতুন কোনও গান করে ফেলবেন না, নিশ্চয়তা দেওয়া যায় কি? আর, তিনি গাইলে সেই গানের আকর্ষণ এবং আবেদন অন্য স্তরে পৌঁছবেই, সে-ও তো নিশ্চিত!

 

আশা ভোঁসলে (বাংলা ছায়াছবির জনপ্রিয় কিছু গান)

সুরকারশ্যামল মিত্র

নেই সেই পূর্ণিমা রাত (রাজকন্যা, ১৯৬৫); যদি হই চোরকাঁটা ওই শাড়ির ভাঁজে (কিশোর), জানি না আজ যে আপন, না না না না এমন করে (অমানুষ ১৯৭৫); কাছে আছ তুমি (শৈলেন্দ্র), নওল কিশোর শ্যামসুন্দর (শৈলেন্দ্র, রফি, শ্যামল), প্রেম কথাটাই ছোট (অজস্র ধন্যবাদ, ১৯৭৬); আমার স্বপ্ন তুমি ওগো (কিশোর), ভালবেসে ডেকেই দেখো না (আনন্দ আশ্রম, ১৯৭৭); আমি কে সে কি ভুলে গেলে, কোনও কাজ (কিশোর), একই সাথে হাত ধরে (কিশোর), নেশা তুমি যতই করো (কলঙ্কিনী, ১৯৮১); কুঞ্জবিহারী হে গিরিধারী (মায়ের আশীর্বাদ, ১৯৮২)

সুরকাররাহুল দেববর্মন

গুন গুনগুন কুঞ্জে আমার (কিশোর), বন্ধ ঘরের অন্ধকারে, সে কি এল (রাজকুমারী, ১৯৭০); ফুলকলি রে ফুলকলি (কিশোর, অনুসন্ধান, ১৯৮০); আধো আলো ছায়াতে (কিশোর), ও আমার কাঁধের আঁচল (কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী, ১৯৮১); জানা অজানা পথে চলেছি (কিশোর, আরডি), আরও কাছাকাছি (কিশোর), একটু বোসো চলে যেও না, কথা হয়েছিল (ত্রয়ী, ১৯৮২); বান্দার সেলাম নাও জনাব (আরডি), নতুন সে তো নতুনই (কিশোর), জানো যদি এ মন কী চায় (তিনমূর্তি, ১৯৮৪); নাগর আমার কাঁচা পিরীত (শৈলেন্দ্র, অন্যায় অবিচার, ১৯৮৫); না না কাছে এসো না (এসপি), এমন মধুর সন্ধ্যায়, হায়রে কালা এ কী জ্বালা, তোলো ছিন্নবীণা, খেলব হোলি রঙ দেব না (একান্ত আপন, ১৯৮৭); শ্যাম ঘনশ্যাম তুমি (আগুন, ১৯৮৮)

সুরকারসুধীন দাশগুপ্ত

ডেকে ডেকে চলে গেছি, কোন সে আলোর স্বপ্ন নিয়ে (প্রথম কদম ফুল, ১৯৭০); আমার দিন কাটে না, আরও দূরে চলো যাই (ছদ্মবেশী, ১৯৭১); আজ দুজনে মন্দ হলে (ফরিয়াদ, ১৯৭১); কেন সর্বনাশের নেশা ধরিয়ে, মন মেতেছে (পিকনিক, ১৯৭২); সাগর ডাকে আয় (জীবন সৈকতে, ১৯৭২); আমি অন্ধকারের যাত্রী (এপার ওপার, ১৯৭৩)

সুরকারহেমন্ত মুখোপাধ্যায়

মেঘের কোলে রোদ হেসেছে (রবীন্দ্রসঙ্গীত, কুহেলি, ১৯৭১); যখন তোমার গানের সরগম (প্রক্সি, ১৯৭৭)

সুরকারঅভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

যদি কানে কানে কিছু বলে বঁধুয়া, ও পাখি উড়ে আয় (জীবন রহস্য, ১৯৭৩)

সুরকারনচিকেতা ঘোষ

পাগলা গারদ কোথায় আছে (মান্না), বেশ করেছি প্রেম করেছি (মৌচাক, ১৯৭৪); আলো আর আলো দিয়ে (স্বয়ংসিদ্ধা, ১৯৭৫)

সুরকারশচীন দেব বর্মন

গুঞ্জনে দোলে যে ভ্রমর (কিশোর, আরাধনা, ১৯৭৬)

সুরকারভূপেন হাজারিকা

কখগঘ চছজঝ (চামেলি মেমসাহেব, ১৯৭৮)

সুরকারস্বপন-জগমোহন

ঢলে যেতে যেতে (কিশোর), কে যায় রে, তারে ভোলানো গেল না (লালকুঠি, ১৯৭৮); জাফরানি রঙ আকাশে (প্রহরী ১৯৮২)

সুরকারবীরেশ্বর সরকার

এক যে ছিল রাজপুত্তুর (কিশোর, মাদার, ১৯৭৯)

সুরকারবাপি লাহিড়ি

তুই যত ফুল দিস না কেনে (ওগো বধু সুন্দরী, ১৯৮০); জানো নাকি তুমি কোথায় (বাপি), তোমরা পয়সা দিয়ে গানকে কেনো, আমি ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখা (প্রতিদান, ১৯৮৩); বলো তো কী করে ঘর বাঁধা যায় (বাপি), ওই নীল পাখিটাকে (বাপি), প্রেম কিসে হয় (দুজনে, ১৯৮৪);  এক যে ছিল দুয়োরানি (প্রতিকার, ১৯৮৭); যেখানেই থাকো, আমি মন দিয়েছি, তোমার মুখটা কী সুন্দর, চিরদিনই তুমি যে আমার (অমরসঙ্গী, ১৯৮৭); আকাশের চাঁদ, ফুল কেন লাল হয় (গুরুদক্ষিণা, ১৯৮৭)

সুরকারঅজয় দাস

আমারই এ কণ্ঠ ভরে (জীবন মরণ, ১৯৮৩); বৃষ্টি থামার শেষে (পারাবত প্রিয়া, ১৯৮৩); গুনগুন করে মন ভ্রমরা যে ওই (অমিত), এ মন আমার হারিয়ে যায় (অনুরোগের ছোঁয়া, ১৯৮৬)

সুরকারমৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়

ঝরঝর ঝরে (অমিত), এই মনটা যদি না থাকত, আমার কুয়াশা যে ওড়না (দুটি পাতা, ১৯৮৩)

সুরকারস্বপন চক্রবর্তী

আছে গৌর নিতাই, বন্ধ মনের দুয়ার দিয়েছি খুলে, এই রাতে একটুখানি কাছে, কে যেন আবীর, রামধনু রঙ নিয়ে (মোহনার দিকে, ১৯৮৪); কথা দিলাম (কিশোর) আজ আমি অচেনা যে (সুরের আকাশে, ১৯৮৮)

4 comments:

  1. Eto lekha, eto ojana kotha....joto porchi totoh somriddho hochhi

    ReplyDelete
  2. লেখাগুলো ছিলই। গতবার একটি বইয়ের জন্য লিখেছিলাম। এখন সেগুলো পাবলিক করে দিচ্ছি, এই আর কী :)

    ReplyDelete
  3. দারুণ হচ্ছে লেখাগুলো!

    ReplyDelete
  4. থ্যাঙ্কু থ্যাঙ্কু স্যর, পড়তে থাকুন৷ প্লিজ... 🙏

    ReplyDelete