Thursday, July 8, 2021

কাশীনাথ ভট্টাচার্য / খুনের মামলায় অভিযুক্ত আসামীর বাড়িতে রিও-তে , মেসিরা প্র্যাকটিসে, বেঘর আমি লটবহর নিয়ে রাস্তায়…

 কাশীনাথ ভট্টাচার্য

সাও পাওলোর সঙ্গে প্রথম আলাপ রাতের অন্ধকারে। কিছু করার ছিল না, উড়ানের সময় তো আর আমার হাতে নেই। কিন্তু রিও দে জানেইরো শহরটাকেও প্রথম দেখা ভরসন্ধেয়, রাস্তার সমস্যায়।

২০১৪ বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচ ছিল সাও পাওলো-তে। তাই কলকাতা থেকে সরাসরি সাও পাওলোতেই পৌঁছেছিলাম। ব্রাজিল-ক্রোয়েশিয়া ম্যাচ দিয়ে বিশ্বকাপ শুরু। তার আগে চমৎকার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান আরেনা দে সাও পাওলো-য়। এত ভাল উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বিশ্বকাপে তার আগে কখনও (টেলিভিশনে) দেখিনি। ব্রাজিলের জয়ের পর প্রেস বক্সে ঠিক করে নেওয়া হল, পরের দিন সকাল-সকাল আমরা পৌঁছে যাব সাও পাওলোর বাসস্ট্যান্ডে, গন্তব্য রিও। ব্রাজিলে ট্রেনের সুবিধা নেই। হয় উড়ে যাওয়া, নয় বাসে। বারবার উড়ে যাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। বাসই একমাত্র ভরসা তাই। খবর যা নিয়েছিলাম, সাড়ে চারশো কিলোমিটারেরও কম রাস্তা, ঘণ্টা ছয়-সাত লাগে। সকাল-সকাল শুরু করলে বিকেলের আগেই পৌঁছে যাওয়া যাবে।

কিন্তু, হিসেব মেলে না! প্রথমত টিকিট কাটতে গিয়ে প্রচুর সময় গেল। দ্বিতীয়ত, আরও কয়েকজন আসবে, অপেক্ষা করতেই হল। শেষমেশ ন’টা নাগাদ যাত্রা শুরু। তাতেও বিকেল তিনটে-চারটের মধ্যে তো অবশ্যই পৌঁছে যাব, ভেবে সান্ত্বনা। আর আমার এক পূর্বপরিচিত, যিনি কথা দিয়েছিলেন রিও-র বাস স্ট্যান্ডে থাকবেন অপেক্ষায়। নিয়ে যাবেন আমাদের, তাঁর ঠিক করে-রাখা আস্তানায় যেখানে বিশ্বকাপের সময় বিভিন্ন ম্যাচের হিসেবে দিন কুড়ি থাকব আমরা। সুতরাং, ‘চিন্তা’-র কোনও ‘ভাবনা’ নেই!

রাস্তায় মাঝে মাঝেই পাহাড়। অন্তত গোটা ছয়েক তো বটেই। তারই মাঝে এক জায়গায় আটকে যেতে হল। উল্টোদিকের রাস্তায় কিছু একটা হয়েছে বোঝা গেল। কাউকে জিজ্ঞেস করে জানার উপায় নেই। আমাদের সে সব ভাবনাও ছিল না। নিজেরাই ছবি তুলতে তুলতে, গপ্পোগুজব করতে করতে সময় কাটিয়ে দিলাম। ঘণ্টাখানেক গেল ওখানে। তারপর পাহাড়ি রাস্তায় জট ছাড়াতে আরও বেশি সময়। তাই, রিও পৌঁছলাম যখন পড়ন্ত বিকেল এবং জানা গেল, সেই পূর্বপরিচিত ভদ্রলোক তখনও এসে পৌঁছতে পারেননি!

তাঁর পৌঁছনোর অপেক্ষায় আরও আধঘণ্টা মতো। গাড়িতে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছতে পৌঁছতেই জানা গেল বিশ্বচ্যাম্পিয়ন স্পেন প্রথমে এগিয়ে গেলেও নেগারল্যান্ডস ফিরে আসছে, প্রথমার্ধ ১-১। আমরা নেমে পড়লাম একটা ছোট রেস্তোরাঁর সামনে। পেছনেই একটা বিরাট বাড়ি, কততলা বোঝার উপায় নেই। বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে রেস্তোরাঁর সামনে দাঁড়িয়ে পড়লাম খেলাটা দেখব বলে। ‘সেই পূর্বপরিচিত ভদ্রলোক’ কথা বলতে গেলেন সেই বাড়িতে। আমরা অপেক্ষায়।

রিও-র সেই প্রথম আস্তানার ব্যালকনি থেকে দেখা কোপাকাবানা
রবেন-ফন পার্সিরা ওদিকে ছিঁড়ে খেতে শুরু করেছেন বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের। রেস্তোরাঁর স্বচ্ছ কাচের সুবিধে নিয়ে আমাদের চোখ সে দিকেই। খেলা শেষ হতে চলল, সেই লোক আর আসেন না! ফোনেও পাচ্ছি না। ব্রাজিলে আবার ফোন করাটা বেশ জ্বালা। প্রতিটি শহরের আলাদা আলাদা কোড, আমাদের এখানে যেমন ‘এসটিডি’ করার সময় জানতেই হত শহরের কোড, তেমন। মুশকিল হল, মোবাইল আসার পর সে সব আর লাগে না। ভিনরাজ্যের নম্বর হলে সামনে একটা ‘জিরো’ দিলেই ল্যাটা চুকে যায়। ব্রাজিলে মোবাইলেও শহরের কোড নম্বর জুড়তে হয়। নানা ফ্যাচাং!

সেই ভদ্রলোক এলেন খেলা শেষ হওয়ার প্রায় আধঘণ্টা পরে, চিন্তিত মুখে। ঝাঁপিয়ে পড়ি আমরা, কী হয়েছে জানতে। বললেন, যার সঙ্গে কথা বলে রেখেছিলেন, সে নাকি কোথায় পালিয়েছে কোনও বেআইনি কাজে জড়িত থেকে। বেআইনি মানে চুরি-টুরি নয়, শোনা যাচ্ছে খুনের মামলায় যুক্ত! মাথায় বাজ বললেও কম। রিও-র অপরাধ জগত সম্পর্কে বহু পড়েছি, সিনেমাও দেখেছি। কিন্তু আমি যেখানে থাকতে চলেছি সেই জায়গার মালিক যদি সরাসরি খুনের মামলায় অভিযুক্ত আসামী হ’ন, জেনে যাওয়ার পর আর কি সেখানে থাকা উচিত?

কিছু করারও নেই। সেই ভদ্রলোকই একমাত্র ভরসা তখন। তিনি আবার ঢুকে গেলেন সেই বাড়ির ভেতর। আমরা ঠায় বসে আছি। পরের ম্যাচটা শুরু হয়েছিল। মাথায় কিছুই ঢুকছে না। ভাগ্যিস ভারতের সঙ্গে সাড়ে আট ঘণ্টা সময়ের পার্থক্য থাকার সুবিধে, আগের দিনের কপি আগের রাতেই লিখে পাঠানো ছিল। অন্তত অফিসের মুখঝামটা শুনতে হবে না, নিশ্চিন্ত। কিন্তু, এখন থাকব কোথায়?

বোধহয় আটটা নাগাদ তিনি বেরিয়ে এসে জানালেন, দিন দুয়েকের জন্য ব্যবস্থা হয়েছে। আপাতত এখানেই থাকতে হবে, অর্থাৎ সেই বিরাট বাড়িটায়। আগামী পরশু সকালে এসে তিনি নিয়ে যাবেন তাঁর ঠিক করে-রাখা আগের বাড়িতে। আশা করছেন, তার মধ্যে সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে এবং সেই অভিযুক্ত আসামীও ফিরে আসবেন। কেন এমন অদ্ভত আশা তাঁর, জানতে চাইনি আর। মালপত্র নিয়ে ঘরে ঢুকে আগে স্নান, তারপর পেটে কিছু দিতে হবে। ভরাপেটে না হয় ভাবব আবার।

গেটে ঢুকতে গিয়েও বিপত্তি। আবার একজন এলেন তালা খুলতে। আমাদের তখন মানসিক অবস্থা যা, কারও চেহারা দেখেই সুবিধের মনে হচ্ছে না! তবু, উঠে পড়ি লিফটে। খুব সম্ভবত এগার-বারতলা ছিল। সেখানে পৌঁছে নির্দিষ্ট ফ্ল্যাটের সামনে পাওয়া গেল এক ব্রাজিলীয় কৃষ্ণাঙ্গ সুন্দরীকে। হাতে চাবি নিয়ে অপেক্ষায়। দোর খুলে দিলেন। ভেতরে ঢুকে নিমেষেই মন ফুরফুরে। এত গোছানো ঝকঝকে সুন্দর!

বুঝিয়েটুঝিয়ে চলে গেলেন তিনি। পূর্বপরিচিত সেই ভদ্রলোকের দাবি এবার, ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, ডলার দিয়ে দিলেই তিনিও চলে যাবেন। দাবি ছিল ওই কুড়ি দিনের জন্য নির্দিষ্ট টাকার পুরোটাই দিতে হবে। রীতিমতো হাতিবাগান স্টাইলে দরাদরি চলল। কোনও মতে দিন দশেকের ডলার দিয়ে মুক্তি। যাওয়ার আগে তিনি আবার দুটো মনে-রাখার কথা বলেও গেলেন। পরশু সকাল-সকাল যেন তৈরি থাকি মালপত্র গুছিয়ে আর যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাঁদিকে যদি হাঁটতে শুরু করি, রাস্তায় প্রথম ক্রসিং-টা পেলেই ফিরে আসতে হবে। পেরিয়ে সোজা যাওয়া চলবে না। বাঁদিকে যেতে পারি শুধু। এবং, ওই ক্রসিংটা পেরিয়ে সোজা চলে যাওয়ার ভুল যেন না-করি একেবারেই। জানতে চাইলেও ভেঙে বললেন না কিছু। কোথায় এসে পড়লাম রে বাবা, বোঝো ঠ্যালা!

রিও-র রাস্তায় আর্জেন্তিনীয় সমর্থকরা

পর দিন সকালে ঘরসংলগ্ন ব্যালকনিতে যেতেই উচ্ছ্বাসে ভেসে-যাওয়া। ওই দেখা যায় কোপাকাবানার নীল জল! ক্যামেরা নিয়ে সকালেই ব্যালকনিতে। আহা রে, এই জায়গাটা ছেড়ে চলে যেতে হবে এক দিন পর, ভাবলেই খারাপ লাগছে তখন। তবে, কাজে বেরতে হবে, ঐতিহ্যশালী মারাকানায় পৌঁছতে হবে ভেবে নিজেকে শান্ত করে চটপট বেরিয়ে পড়ি। সাবধানবাণী মেনে রাস্তায় নেমে বাঁদিকে যাওয়াই নেই! ডানদিক দিয়ে বড় রাস্তায় এবং নিজেদের গন্তব্যে। সারা দিন কাজ সেরে রাতে আস্তানায় ফিরে গোছগাছ। পরের সকালে বেরনোর প্রস্তুতি।

আর সময়ে ভুল নেই। সকালেই চলে এলেন তিনি। আমরাও তৈরিই ছিলাম। স্নান করার দরকার নেই, নতুন জায়গায় গিয়েই হবে। লটবহর নিয়ে নীচে নেমে এলাম। দুটি গাড়ি দাঁড়িয়ে। একটি সেই ভদ্রলোকের, অন্যটি আমাদের জন্য। পরিচিত ভদ্রলোকের সঙ্গের গাড়িতে গেলাম আমি, আমার সঙ্গী অন্য গাড়িতে। শুরু হল পথচলা, শুরু হল কথাবলা।

রিও শহরটা জুড়েই সমুদ্র। পরপর বেশ কিছু বিখ্যাত সৈকত। কোপাকাবানা আর ইপানেমা দুটি পরিচিত নাম ছাড়াও আরও সাত-আটটি আছে শহরের পার্শ্বরেখা বরাবর। তখন সে সব মনে ছিল, এখন আর গুগলাতে ইচ্ছে করছে না। গাড়ি চলতে শুরু করার পর একে-একে সেই ভদ্রলোক নাম বলে চলেছেন। কোপাকাবানা, ইপানেমা গেল, তারপরও গোটা দুই। প্রায় মিনিট চল্লিশেক পেরিয়েছি, অধৈর্য হয়ে পড়ি এবার। গন্তব্য আর কত দূর?

‘এই তো, এসে পড়লাম বলে’ শুনতে শুনতে এবার বিরক্তি চরম। ঘণ্টাখানেক হয়ে যাওয়ার পরও যখন পৌঁছলাম না, গাড়ি থামাতে বলি, খানিকটা জোরেই। চালক থামিয়ে দেন, ভদ্রলোক থামতে রাজি নন। ‘আর একটু, আর একটু’ তখনও বলে চলেছেন। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গিয়েছে আমার। জানিয়ে দিই, ‘যাচ্ছি যখন, শেষ পর্যন্ত যাবও হয়ত, তবে থাকব না’!

‘চলুন না, জায়গাটা দেখে সিদ্ধান্ত নেবেন। যেখানে ছিলেন তার চেয়েও ভাল জায়গা। জানেনই না, স্থানীয় এই অঞ্চলেই রোমারিও এবং রোনালদোর ফ্ল্যাটও আছে।’ আগে জেনে নিই, ওঁরা থাকেন কিনা। যখন জানা গেল, থাকেন না, অল্প যেটুকু দ্বিধা তৈরি হয়েছিল, উধাও। ‘চলুন, ফিরে যাই’!

এত দূর এসেও সুসজ্জিত বাড়িটা একবার দেখবেন না? দেখলেই মন পাল্টে যাবে, আগে দেখে নিন। যতবার তিনি এমন বলেন, আমার মন আরও বিদ্রোহ করে। ঘড়ি বলছে, পৌঁছতে এক ঘণ্টা কুড়ি মিনিট মতো লেগেছে। কথা বলতে বলতেই দেখেও নিয়েছিলাম, মূল বড় রাস্তা থেকে ভেতরে ঢুকেও মিনিট পনের মতো ট্যাক্সি চলেছে। আর সেই রাস্তাটায় বাস গোছের কিছুই চলে না। অর্থাৎ, ঘর থেকে বেরিয়েই ট্যাক্সি নিয়ে বড় রাস্তায় পৌঁছতে হবে। মনস্থির, থাকব না। ভেতরে যাই, দেখে খুবই ভাল লেগেছিল। তিন-কামরার অ্যাপার্টমেন্ট, আগের চেয়েও বেশি গোছানো। কিন্তু থাকব কী করে? আমি তো ‘ভাল’ থাকতে আসিনি, কাজ করতে এসেছি!

মারাকানা থেকে প্রায় দু-ঘণ্টার দূরত্বে বাড়ি সুসজ্জিত হলেও কি থাকা সম্ভব? কাজ শেষ হয় রাতে। ম্যাচের পর প্রেস কনফারেন্স, লেখালেখি শেষ করে বেরতে আরও ঘণ্টাদুয়েক তো লাগেই। রাত এগারটা মারাকানা থেকে বেরিয়ে রাত একটায় পৌঁছব নাকি এখানে? পূর্বপরিচিত রেগে যান। এত কষ্ট করে খুঁজে এত ভাল থাকার ব্যবস্থা করলেন, আমার পছন্দ হচ্ছে না? বোঝাতে চেষ্টা করি, কাজের ব্যাখ্যা দিয়ে। বোঝেন না। বুঝলেন সেই ফ্ল্যাটের মালিক। সৌভাগ্য, তিনিও ইংরেজি বোঝেন। আমার প্রতিটি কথা মনে দিয়ে শুনে তিনিই সেই পূর্বপরিচিতকে পর্তুগিজেই বোঝালেন, সত্যিই বড় সমস্যা, আমার পক্ষে এখানে থাকা মুশকিল। তাঁদের কথার বিন্দুবিসর্গ বুঝি না। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরতে পারলে বাঁচি।

ফিরে চলো শহরে এবার। কিন্তু সেই যে অতগুলো ডলার দিয়েছিলাম হাতে তুলে প্রথম দিন, থাকলাম তো দেড়দিন, দুটো রাত। ফেরত দিন বলতেই আবার একদফা কথা কাটাকাটি। আমাকে বলা হল, ‘আপনি থাকুন এখানে, থাকার জায়গা করে দিলাম, পয়সা ফেরত আবার কী?’ এবার মাথায় রক্ত উঠতে চায়। মারাকানায় পরের দিন নামবে আর্জেন্তিনা। লিওনেল মেসিরা অনুশীলন করবেন, বিকেল-বিকেল মাঠে না পৌঁছলে আমার তো সবই যাবে। আর আমি কিনা তখনও ঝগড়া করে যাচ্ছি, রিও-র শহরতলির কোনও এক আবাসনে দাঁড়িয়ে!

 আর্জেন্তিনার সেই বিশ্বকাপে প্রথম প্রেস কনফারেন্সে সাবেয়া-রোমেরো

অগ্রাধিকার, বোঝাই নিজেকে। সেই পূর্বপরিচিতকে কড়া ভাষায় জানিয়ে দিই, আমাকে ফিরতেই হবে এখন। ওঁর কাছে ডলার সেই মুহূর্তে না থাকলেও সমস্যা নেই। আরও দিন তিনেক আছিই, পরেও দফায় দফায় আরও দিন পনের থাকব। মেল আইডি ফোন নম্বর সবই আছে। আদায় যেভাবেই হোক করব। তবে, ভাল হবে নিজেই ফেরত দিয়ে দিলে। এমন শাসানি দিয়েই বেরিয়ে আসি সেই বাড়ি থেকে।

ফেরার সময় পূর্বপরিচিত আর ওঠেন না গাড়িতে। আমরাই একটি ট্যাক্সিতে, মালপত্রসহ। ভাবছি, কোথায় যাব। থাকার জায়গা নেই। হোটেল কত দামী, জানা ছিল বলেই সেই পূর্বপরিচিতের সঙ্গে কথাবার্তা। রাস্তায় খোঁজার উপায়ও নেই। ট্যাক্সিচালককে জানাই, মারাকানা যাব। ওখানে অনেককেই দেখেছিলাম, মালপত্রসহ ঢুকতে। যদিও আমাদের মতো একেকজনের সঙ্গে দুটো সুটকেস ছিল না কারও! তবু, মনে হল ওখানে গিয়ে অন্তত ইন্টারনেটটা দেখা যাবে। প্রয়োজনে একটা রাতের জন্য বেশি টাকা খরচ করেও মাথা গোঁজার জায়গা বের করতেই হবে। তারপর অন্য সব। সুতরাং, মারাকানার প্রেস সেন্টার যাওয়াটাই ঠিক।

সেই ট্যাক্সিচালকের নাম ছিল ইগর। হ্যাঁ, ব্রাজিলে রুশ নামের চালক। তিনিও সমস্যা বুঝে দু-একটা পরামর্শ দিচ্ছিলেন। সত্যিই ভদ্র। টানা ট্যাক্সিতে ঘণ্টা দেড়েক পর মারাকানা পৌঁছেছি, তিনিই পরামর্শ দিলেন, অপেক্ষা করবেন।। সঙ্গী এবং মালপত্র রেখে আমি দৌড়ই ভেতরে।

মিডিয়া সেন্টারের বাইরে প্রশস্ত জায়গা আমাদের, সিগারেট খাওয়ার। উদভ্রান্তের মতো সেখানে ঢুকতে গিয়ে মনে পড়ে, সেই যে বাড়ি ছেড়ে বেরলাম, সিগারেটেও টান দেওয়া হয়নি। দাঁড়িয়ে পড়ি। তখনই অনতি দূর থেকে আওয়াজ, ‘আরে কাশীভাই, ক্যায়া হুয়া? আপ অচ্ছে নেহি দিখতে হো।’

উমেদ ওয়াসিম! পাকিস্তানের সাংবাদিক, ‘ডন’ কাগজের। উমেদের বয়স বছর আঠাশ। পাকিস্তানের মিডিয়া-ইতিহাসে প্রথম সাংবাদিক যে ফুটবল বিশ্বকাপ করতে এসেছে! আলাপ হয়েছিল সাও পাওলো-তেই, ওই সিগারেট খেতে গিয়ে। পাশে কেউ চোস্ত উর্দূ বলছে শুনে যেচেই আলাপ করেছিলাম। তারপর আমাদের সঙ্গী হয়ে পড়েছিল উমেদ। রিও-তে আমরা চলে আসব শুনে একই বাসে এসেছিল শুধু নয়, প্রথম রাতটা রিওতে ছিলও আমার সঙ্গেই। ওর বুকিং ছিল পরের দিন থেকে। রিওত সেই প্রথম রাতে আমাদের সেই ফ্ল্যাটে থেকে গিয়েছিল। পরের দিন সকালে ওর থাকার জায়গা যেখানে, চলে গিয়েছিল ফিফা-নির্দিষ্ট ‘হোটেল নিসে’-তে। সেই উমেদ!

মানুষ সমস্যায় পড়লে যা হয়, প্রথমে যাঁর সঙ্গে দেখা হয়, গড়গড় করে বলে ফেলে সব। দুটো সিগারেট পুড়ল দুজনেরই। সব জানালাম। উমেদ বলল, ‘কাশীভাই, আপ রুকো, ম্যায় আ রহা হুঁ।’ কী, কেন – জানতে চাই। ‘আপ রুকো ইধার’, বলে উমেদ চলে যায় ভেতরে। আমিও বোকার মতোই দাঁড়িয়ে বাইরে। মিনিট পাঁচেক, ফিরে আসে উমেদ, ল্যাপটপের ব্যাগসহ। ‘আপকা ট্যাক্সি হ্যায় না বাহার?’ জানাই, হ্যাঁ। ‘চলো, মেরে হোটেল’!

ট্যাক্সিতে উঠে জানায়, ওর হোটেলের ঘরটা যথেষ্ট বড়। একটা আলাদা বেড নিয়ে নেওয়া যাবে। সেই রাতটা ওর ঘরেই থাকা সম্ভব। তারপর নিজেরা খুঁজে নেব পরের আস্তানা। চাইলে ওর ওখানেও থেকে যেতে পারি পরের দুটো দিন, ইত্যাদি। হাতে চাঁদ আমাদের দুজনের। হ্যাঁ, আমার সঙ্গে এই গোটা ঝামেলাটা মোটামুটি মুখ চুন করে কাটিয়েছিল শুভ্র মুখোপাধ্যায়, গণশক্তি কাগজের হয়ে যে গিয়েছিল ব্রাজিলে বিশ্বকাপ ‘কভার’ করতে আর শুরুর দিনটা বাদ দিয়ে পরের রাত থেকেই সঙ্গী ছিল সেই একচল্লিশ দিন।

উমেদের হোটেলে এসে পাসপোর্ট দেখিয়ে আগে বন্দোবস্ত করে ফেলা গেল। ‘বেড’ পরে আসবে, উমেদ বলল, আগে স্নানটান সেরে, খেয়েদেয়ে তাড়াতাড়ি মাঠ ফেরার কথা। মেসি নামবে যে প্র্যাকটিসে!

বিশ্বকাপে দেখা মেসির প্রথম প্র্যাকটিস

ঝড়ের মতো সব কাগজপত্র ঠিকঠাক করে নিজেদের স্নান-খাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়ি কাজে। ফিফার হোটেল, নীচেই অপেক্ষা করে মারাকানা নিয়ে যাওয়ার বাস। তখন তিনটে মতো দুপুর। বাসে উঠে আধঘণ্টায় মারাকানা পৌঁছেই আলেখান্দ্রো সাবেয়া ও সের্খিও রোমেরোর প্রেস কনফারেন্স মিটিয়ে মাঠের ভেতর ঢুকে দেখি, প্র্যাকটিসে নামছেন মেসিরা!

কিচ্ছু ‘মিস’ করতে হয়নি, করতে দেয়নি উমেদ। রাতে ওর ঘরে বসে খুঁজে ফেলি পরের দফায় রিও-তে থাকার আস্তানাগুলো, ইন্টারনেটের সাহায্যে। সাও পাওলো-তে আইবিস-এ ছিলাম, ওদের কাছে ফোন করার পরামর্শটাও দিয়েছিল উমেদই সুবিধা হয়ে যায়, রিও-র আইবিস-এ ঠাঁই মেলে। মনে পড়ে যায় আবারও সেই পূর্বপরিচিতের প্রচ্ছন্ন হুমকি – বিশ্বকাপের মধ্যে রিও শহরের ভেতর কী করে হোটেল খুঁজে পাই আমরা, তিনি নকি দেখে নেবেন! আরও জানিয়েছিলেন, দিন তিনেক ধরে রাখবেন তাঁর সেই শহরতলির ঠিক করে-দেওয়া ফ্ল্যাটটা, কারণ আমাদের তো আবার তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে। আমিও বলে এসেছিলাম, দরকারে মারাকানা মিডিয়া সেন্টারেই থেকে যাব, ওঁর কাছে ফ্ল্যাটের জন্য যাব না আর!

পাকিস্তানি সাংবাদিক উমেদ ওয়াসিম-এর সঙ্গে

গত এই সাত বছরে উমেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব জমজমাট। এতটাই যে, রাশিয়া বিশ্বকাপের আগে থেকেই জানিয়ে দিয়েছিল, একসঙ্গে থাকবে, ‘আপ দেখ লিজিয়ে, ম্যাঁয় কুছ নেহি করুঙ্গা।’ ছিলামও। ওর বিয়েতে নেমন্তন্ন করেছিল। ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের কারণে যেতে পারিনি। ওর মিষ্টি বউ গিয়েছিল মস্কোতে ফাইনলের ঠিক আগে। কত গল্প, কত আড্ডা!

বিশ্বকাপ ‘কভার’ করতে গিয়ে অনেক কিছুর মাঝে আমার বিরাট প্রাপ্তি, পাকিস্তানের বন্ধু উমেদ ওয়াসিম। জানি এই লেখাটার একটা শব্দও পড়তে পারবে না উমেদ। তাতে কিছু যায় আসে না। ধন্যবাদ জানিয়ে ওকে ছোট করা অসম্ভব। যদ্দিন না আবার দেখা হচ্ছে, খুশ রহো ইয়ার!

6 comments:

  1. Darun kashi da darun. Sob chobir moto mone pore gelo... Aro lekho tumi... Tomar bhandar e to anek moni mukto...

    ReplyDelete
    Replies
    1. আর সেই সব মণিমুক্তোর তো তুই সাক্ষী!! তুইই বা লিখবি না কেন! ভাল থাক 😃

      Delete
  2. অসাধারণ দাদা, দারুণ লাগল পড়ে

    ReplyDelete
  3. একেবারে cinema র মতো filmic

    ReplyDelete