Friday, July 9, 2021

কাশীনাথ ভট্টাচার্য / ফাভেলার সিঁড়ি বেয়ে ওঠার রোমাঞ্চ আর ‘এলিপোন্তো’-র ঘোলেই ‘রিডিমার’ দুধের স্বাদ

‘‘গোল বলের পেছনে ছুটতে ছুটতে আমরা কি ক্রমশ ছাগোল হয়ে পড়ছি না রে কাশী?’’ 

প্রশ্নকর্তা বাবু সৌম্যজিৎ বসু, টাইমস অফ ইনডিয়ার ফুটবললিখিয়ে। বিশ্বকাপ শুরুর দিন দশেক পর ব্রাজিল পৌঁছেছিলেন নিজের কিছু কাজে আটকে গিয়ে। তখন এটাই ক্রমশ নিয়ম। রোজই বেশ ভেবেচিন্তে কিছু একটা বলে সৌম্যজিৎ আর আমরা হইহই করে ওকে থামিয়ে দিয়ে নিজের নিজের কথা বলতে শুরু করি, মিটিং যায় ভেস্তে!

চারজনের দুর্দান্ত গ্রুপ গড়ে উঠেছে। সৌম্যজিৎ, শুভ্র, উমেদ আর আমি। শুভ্র সারাদিন-সারারাত লিখেই চলেছে, শেষ নেই। যতবারই জানতে চাই, বলে, ‘না গো, এই স্টোরিটা লিখে দিতেই হবে।’ কী স্টোরি, কোথায় পাচ্ছে, কেল লিখছে --- আমাদের কাজের জীবন রীতিমতো সংশয়ে! একই জায়গা থেকে একটা ছেলে স্টোরির পর স্টোরি দিয়ে যাচ্ছে আর আমরা ভ্যারেন্ডা ভাজছি, একেবারে আক্ষরিক অর্থে। উমেদ আর সৌম্যজিৎ চটপট লেখা শেষ করত। আমি একটু সময় নিতাম, তবে শুভ্রর মতো নয়! তারপর দিনের খেলাশেষে বা বেলাশেষে ছোটখাটো মিটিং, আগামিকাল কোথায় যাব, কী কী করব ইত্যাদি। তখনই সেই ছাগল-জিজ্ঞাসা সৌম্যজিতের।

কারণটা খোলসা করেই বলা যাক। দিনটা ২ জুলাই ২০১৪। আমরা রিও-তে। দু’দিন পর ফ্রান্স-জার্মানি কোয়ার্টার ফাইনাল মারাকানায়। সাও পাওলোয় ১ জুলাই আর্জেন্তিনা-সুইৎজারল্যান্ড ম্যাচ করে গভীর রাতের বাস ধরে দুপুর-দুপুর পৌঁছে গিয়েছি রিও-তে। অভ্যাসমতো মারাকানা ঘুরে হোটেলের পথে যেতে যেতেই আলোচনা চলছে, ফিফার বাসে। উমেদ নেমে যাবে ওর হোটেলে, আমরা চলে আসব আমাদের আইবিস-এ।
সৌম্যজিতের বলার উদ্দেশ্য, প্রতিযোগিতা শেষ হতে চলেছে, আমরা তত দিনে বার তিনেক রিও চলে এসেছি, আবার ওখান থেকে অন্য শহরে চলেও গিয়েছি। বাবু বলছিলেন সখেদ, ‘একটা বেলাও কি আমরা এই সব মারাকানা-ফারাকানা ছেড়ে একটু শহরটা ঘুরে দেখতে যেতে পারি না? এতই কাজ আমাদের! রিও এসে ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার দেখব না, কোপাকাবানা বিচে গিয়ে শুয়ে থাকব না – বাড়ি ফিরে পাড়াপড়শিকে তো মুখ দেখানোর সুযোগটাও দিলি না রে কাশী!’ 

ঘটনা, যাকে বলে, নির্জলা সত্যি! কোপাকাবানা বিচের পাশ দিয়ে ফিফার বাস নিয়ে যেত, ওই বাস থেকেই জানলার পর্দা সরিয়ে দেখা যতটুকু। ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার দেখা যায় মারাকানা স্টেডিয়াম থেকে, ব্যস্। কাজের শেষ নেই, লিখে ফাটিয়ে দিচ্ছি সবাই, ক্রীড়া সাংবাদিকতার ইতিহাসে আমাদের সেই সব প্রতিবেদন অমরত্ব দাবি করছে মনে করে আমাদের হাঁটাচলাই পাল্টে গিয়েছে প্রায়! আসলে যে কোথায় কে কী বলছে আর ম্যাচ রিপোর্ট-এর বাইরে যেতেই পারছি না, ভাবার সময়ও নেই। বিশ্বকাপ, তাই না!

সেই দিন কিন্তু আমরা একমত হলাম, এটা সত্যিই বাড়াবাড়ি। এবং, পরের দিন যেহেতু বিকেল চারটের আগে ফ্রান্স এবং জার্মানির প্রেস কনফারেন্স নেই, তিনটে পর্যন্ত আমাদের হাতে ফাঁকা সময়। শুভ্র, যথারীতি, লেখার কথা বলেছিল। থামিয়ে দিই হইহই করে। ব্রাজিলের চেযে ভারত সাড়ে আট ঘণ্টা এগিয়ে। আমাদের সবাইকেই ব্রাজিলীয় সময় দুপুর একটা-দেড়টার মধ্যে লেখা পাঠিয়ে দিতে হত। ম্যাচ ধরানোর প্রশ্নই থাকত না। তাই ম্যাচের পরের কপিগুলো রেখে দেওয়া হত পরের দিন ঠিক সময়ে পাঠানো হবে বলে। সেই রাতে বা পরের সকালে লিখে ফেলে বেরিয়ে পড়তাম পরের দিনের খাবার, থুড়ি, খবরের সন্ধানে। তাই ঠিক করে নেওয়া হল, সেই রাতেই পরের দিন সকালে যা যা পাঠানোর, পাঠিয়ে রাখতে হবে। আমরা ঘুরতে বেরব!

হোটেলের ডেস্ক-এ কথা বলে পাওয়া গেল এক চালকের মোবাইল নম্বর। এমন চালক যিনি ইংরেজি জানেন। একটা গোটা বেলা ঘুরে বেড়াব আর চালকের সঙ্গে কোনও কথা হবে না আকার-ইঙ্গিত ছাড়া – হয় নাকি? পাওয়া মুশকিল, তবু, জানা গেল, একজন আছেন। তাঁর মোবাইল নম্বর পেলাম। কথা বলে নেওয়া হল। সকাল সাতটায় চলে আসবেন তিনি। আমরা রেডি হয়ে থাকি যেন। শহরের দ্রষ্টব্য স্থানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখাবেন। আমরা মহাখুশি।

সকালে যথারীতি তিনটে বাঙালি আধঘণ্টা দেরি করল। ওদিকে ‘হোটেল নিসে’ থেকে উমেদ ফোন করেই চলেছে, আর আমাদের ঘরে-ঘরে ‘এই তো, বেরচ্ছি’ চলছে। কোনও রকমে বেরিয়ে এসেই চালক কার্লোসের ধমক, ‘এত দেরি করলে চলবে? ও দিকে যে লাইন পড়ে গ্যালো!’ কীসের লাইন, শুনি গাড়িতে উঠে। উমেদকেও তুলে নেওয়া হল। ততক্ষণে জেনে গিয়েছি ‘মুক্তিদাতা’ যিশুর মূর্তির কাছাকাছি যাওয়া হয়ত হবে না। কার্লোস নাকি আসার সময়ই দেখে এসেছে বিরাট ভিড়। আর আমাদের সবারই ইচ্ছে, রিও-র সেই বিপজ্জনক ‘ফাভেলা’ দেখার। এত গল্প শুনেছি, গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো। একবার তো যেতেই হবে। আর আজই সেই সময়। সুতরাং, প্রথমে যাওয়া যাক তেমন কোনও একটা বিপজ্জনক বস্তি দেখতে।

রিও-র এই বস্তি অঞ্চলগুলো অপরাধের স্বর্গরাজ্য বলে কথিতই শুধু নয়, হাড়ে হাড়ে সত্যিও। ড্রাগস-এর আঁতুড়ঘর, ছুরি-টুরি নয়, গোলাগুলি চলে অহরহ। কাউকে পছন্দ না হলেই, ব্যস! ব্রাজিল যাওয়ার আগে যা যা পড়া এবং দেখা ছিল ‘মাস্ট’, একটি সিনেমাও ছিল। ‘সিদাদে দে দেউস’, ইংরেজিতে ‘সিটি অফ গড’। অমন আর দেখা হয়নি বিশেষ। বস্তির বাচ্চারা এবং বড়রাও অবশ্যই, কী অনায়াসেই না মানুষ মেরে ফেলেন ইত্যাদি নিয়ে। সত্যি ঘটনা অবলম্বনে তৈরি সিনেমা বিশ্বজোড়া খ্যাতি পেয়েছিল। আমাদের চালক কার্লোসকে অত বলতেও হয়নি। তিনি জানালেন, তুলনায় কম বিপজ্জনক ফাভেলাও আছে। কোনও একটিতে নিয়ে যাবেন যা কাছাকাছি এবং অবশ্যই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসা যাবে। টেনশন যা-ই হোক না কেন, আমরা তৈরি!

গাড়ি চলছে, আমরা গপ্পোগুজব করছি। হঠাৎ একটি জায়গায় কার্লোস গাড়ি থামিয়ে দিলেন রাস্তার ধারে। আর বলে ফেললেন, ‘প্রত্যেকের ক্যামেরা, মোবাইল, ল্যাপটপের ব্যাগ, মানি ব্যাগ বের করে আমাকে দিন।’ আমরা প্রথমটায় অবাকই হয়েছিলাম। কার্লোস বুঝতে পেরে শুধরে নেন নিজেকে। ‘আমরা কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছি। আপনারা কেউ হাতে বা পকেটে কিছু নিয়ে বেরবেন না। শুধু বুকপকেটে ৩০-৪০ রেয়াইস রেখে দিন। বাকি সব থাকবে আমার গাড়িতে। আমি নীচেই থাকব। যে জায়গাটায় গাড়ি রাখব, সামনেই সিঁড়ি পাবেন। তরতর করে উঠে যাবেন, আবার নেমেও আসবেন। চেষ্টা করবেন যেন কারও সঙ্গে কথা না বলতে হয়। আর কোনওভাবেই উঁচু স্বরে কোনও কথা বলবেন না।’

 
সেই চালকের সঙ্গে শুভ্র আর উমেদ
এবার বুক কাঁপতে শুরু। কে যেন জিজ্ঞেস করেই ফেলল, ‘আচ্ছা ওই বুকপকেটে রেয়াইস কেন রাখতে বললেন?’ জবাব শুনে গা হিম। যদি কেউ ছিনতাই করতে আসে, কিছুই না পেয়ে রেগে গিয়েও তো গুলি চালিয়ে দিতে পারে! এবার আমরা ভাবতে শুরু করি, যাওয়া কি উচিত হবে? কার্লোস আবার অভয় দেন, ‘না না, নর্মালি গিয়ে চলে এলে বিশেষ কিছু হয় না। সাবধানে যান, চটপট দেখে ফিরে আসুন।’ আশ্বাস পেয়ে খানিকটা সাহস সঞ্চিত হল কিনা বলতে পারছি না, তবে, চটপট নিজেদের সব কিছু কার্লোসের গাড়িতে জমা করে ফেলি। কার্লোস আবার সেই সব রেখে দেন সিটের তলায়, হঠাৎ তাকালে যাতে নজরে না পড়ে। খানিকটা গিয়ে তারপর থেমে গেল গাড়ি। সামনে একটা চওড়া সিঁড়ি। অনেকটা উঁচুতে উঠে গিয়েছে। কোথাও কোনও জনমানুষের চিহ্ন নেই। চালকসাহেব বলে দিলেন, ‘মিনিট দশেক সময় দিলাম, যান চট করে ঘুরে আসুন। পাঁচ-ছ’মিনিট উঠবেন ঘড়ি দেখে, ফিরে আসবেন। বেশিক্ষণ দাঁড়ালে আমারও বিপদ।’ 

কী দেখব, কীসের সামনে পড়তে হবে কিছুই জানি না, তবু মানুষের কিছু অদ্ভুত কৌতূহল থাকে। আজ সেই দিনের কথা লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে, আমরা ওখানে কেন গিয়েছিলাম? কীসের সন্ধানে? আমরা কি চেয়েছিলাম, কেউ এসে আমাদের ভয় দেখাক? মানে ঠিক কোন্ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে চেয়ে আমাদের সেই অভিযান? যেচে বিপদ ডেকে আনার কি কোনও মানে হয়? কিন্তু সেই সকালে তুমুল ভয়ের পাশাপাশি ইচ্ছেটাও ছিল যে, একবার অন্তত পরিবেশটা দেখে আসি। সেটাও অস্বীকার করতে পারিনি অন্তত সেই দিন। তাই ‘মুক্তিদাতা’-কে ছেড়ে দিয়ে আমরা ফাভেলা-সন্ধানী।

গাড়ি থেকে নেমে চারজনই পরস্পেরর দিকে তাকাই। উঠতে শুরু করি সেই সিঁড়িগুলো বেয়ে। কয়েকটা সিঁড়ি যেতেই দু’দিকে বাঁক, গলির মতো, ভেতরে। অজস্র ঘর, টিপিক্যাল বস্তি। যদিও সেই সিঁড়ি বা যতটুকু চোখ যাচ্ছিল, নোংরা বা আবর্জনা দেখিনি, এমনক চ্যাঁচামেচিও শুনিনি। হঠাৎ একটা বাঁক থেকে বেরিয়ে এলেন এক হিপি। মদের গন্ধে ম ম করছে। আমাদের দেখলেন, আমরা চোখ সরিয়ে নিতে গিয়েও পারলাম না। কিন্তু কিছু বললেন না, টলমল করতে করতে হাতের সিগারেটে টান। গন্ধে মনে হল গাঁজা। চোখাচোখি, সৌম্যজিৎ ঘাড় নাড়ল, শুভ্রও। উমেদ কিছু না বলেই উঠে চলেছে, আমরাও পেছন পেছন। দাঁড়ানো চলবে না যে!
আমরা চারমূর্তি!
৬০-৭০টা সিঁড়ি উঠেছিলাম। অপ্রীতিকর কোনও দৃশ্য বা ঘটনার মুখোমুখি হইনি। একজায়গায় দুজন কমবয়সিকে প্রেম করতে দেখেছিলাম ঘন হয়ে, ওটুকুই। আমাদের পাত্তা দেয়নি, আমরাও না। একটা নির্দিষ্ট জায়গা পর্যন্ত গিয়েই অ্যাবাউট টার্ন। নামার গতি বোধহয় আরও বেশি। নির্ধারিত ওই মিনিট পনের-র মধ্যেই সোজা এসে গাড়িতে এবং শঙ্কর মহাদেবন তাঁর সেই বিখ্যাত ‘ব্রেথলেস’ গানের শেষে যেমন বেশ জোরে শ্বাস ছাড়েন একবার, আমরা চারজনই গাড়িতে সেঁধিয়ে বোধহয় তার চেয়েও জোরে ছাড়লাম, শব্দ করেই। কার্লোসের গাড়ির ইঞ্জিন আমাদের নামতে দেখেই তৈরি ছিল। আমরা চারজন উঠে পড়তেই এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে বেরিয়ে পড়ল। একটু স্বাভাবিক হয়ে আমাদের কারও একজনের বোধহয় মনে পড়েছিল যে, এমন একটা জায়গার কোনও ছবি তোলা হল না? চালকই প্রায় মারতে আসেন শুনে!

‘আপনাদের সবই তো আমার গাড়িতে ছিল, ছবিটা তুলবেন কী করে? আর, ছবি তুলতে গিয়ে ক্যামেরাটা চলে গেলে দায়িত্বটা কার? আপনাদের নিয়ে এসেছি আমি, পরে তো আমাকেই গালাগাল করতেন, তাই না?’ 

মানুষের ভালবাসা বড় ছোঁয়াচে! বিশ্বকাপের সময় ব্রাজিল জুড়ে অপরাধের মাত্রা কমেছিল, সত্যি যেমন, এই মানুষগুলোও, রাস্তায় যাঁরা আমাদের সঙ্গে চলতেন, সেই কাজে সাহায্য করেছিলেন প্রচুর। বিপদের সম্ভাবনা আঁচ করলে নিজেরাও দাঁড়িয়ে পড়তেন বা সঙ্গ দিতেন, পাহারা দিতেন এমনভাবে, প্রথমে ভয় পেতাম, পরে বুঝতে পারতাম যে, ওঁরা সাহায্যই করছেন। মনে আছে, রিওতে আইবিস থেকে বেরিয়ে খেতে যেতাম যে রাস্তায়, মাঝে একটা বেশ বড় মাঠ ছিল। দিনের বেলা কিছু মনে হয়নি। রাতে ওই ন’টা নাগাদ বেরিয়ে মনে হয়েছিল আধো আলোছায়ায় ওই মাঠটা পেরিয়ে যাওয়াটা উচিত হবে কি? একটু দাঁড়ালাম। আধো আলোয় চোখ সইয়ে নিয়ে দেখি কিছু মানুষ হাঁটছেন। আমরা একটু জোরে হেঁটেই ওদের পিছু নিলাম যখন, ওদের গতি কমে গেল! এগোলাম না কাছে। দূরে দেখতে পেলাম একটা গাড়ি কোণাকুণি দাঁড়িয়ে, সামনে দুজন পুলিশ, স্বস্তি। আমরা সেই মানুষগুলোর পেছন পেছন এলাম, একটু দূরত্ব রেখে। ওরাও কিছুই বলেননি। মাঠ শেষ হতেই আমরা খবারের রাস্তায় ঢুকছি যখন, ওরা নিজেদের রাস্তায় চলে গেলেন। এমন বেশ কয়েকবার হয়েছিল। একটুও ভয় লাগেনি তারপর আরও রাত করে খেতে বেরিয়েও।

যাক, আমাদের সেই অভিযানে ফিরি। এবার তো তা হলে ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার? চালকসাহেব জানালেন, অবশ্যই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, এগোলাম। নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দেখি, লাইনের দৈর্ঘ্য মোটামুটি তিন-চার মাইল হবে! পাহাড় থেকে নীচে নেমে এসেছে। অভিজ্ঞ কার্লোস সরাসরি জানালেন, সেই দিন বোধহয় কাকভোর থেকেই লাইন পড়েছিল। না হলে এমন হয় না। এই লাইনে দাঁড়ালে বিকেল বা সন্ধেও হয়ে যেতে পারে!
অগত্যা, কী করণীয়? আলোচনা শুরু। নিয়মটা জানা গেল। মূর্তির কাছে যেতে হলে আমাদের এই গাড়িতে করে যাওয়া যাবে না। ওই লাইনে দাঁড়াতে হবে। সরকারি বাস আসবে ওপর থেকে। নিয়ে যাবে। বাসের সবাই ঘুরে ফেললে আবার ওদের নিয়ে ফিরে আসবে আর তুলে নিয়ে যাবে পরের দলকে। বাস আছে বেশ কয়েকটা। তবে, এক-একটা বাস মানে ঘণ্টা দুয়েক তো বটেই, যা ভিড় তাতে নামতেও সময় বেশি লাগবে। সকাল গড়িয়ে তখন দুপুরের পথে, সূর্য নব্বই ডিগ্রিতে। ফিরে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। মনটা খারাপই।
কিন্তু চালক সাহেব আছেন যে! বললেন নিয়ে যাবেন একটু দূর পর্যন্ত, যত দূর গাড়ি যেতে দেয়। হেলিকপ্টার পয়েন্ট বলে একটি জায়গা আছে, যেখান থেকে হেলিকপ্টারে করে উড়ে যিশুর মাথার ওপর দিয়ে ঘুরে নেমে আসা যায়। তবে তা বেশ খরচসাপেক্ষ। আর তার জন্যও বুকিং করতে হবে। আমরা তখন যদ্দূর যাওয়া যায়, ঘুরে তো আসি মনোভাব নিয়ে লাইনে না দাঁড়িয়ে আবার গাড়িতে। মোটামুটি একটা দূরত্ব যাওয়ার পর গাড়ি থামল। কার্লোস নিজেই ক্যামেরাগুলো বের করে দিলেন এবার, মোবাইল, মানিব্যাগ - সব। নিজেও নেমে পড়লেন, আমাদের সঙ্গে, ঘুরিয়ে দেখাবেন বলে। হইহই করে আমরাও। 

ওই তো দেখা যাচ্ছে মুক্তিদাতা যিশু, দাঁড়িয়ে আছেন দু’হাত ছড়িয়ে, বুকে টেনে নিতে! ‘ওই তো’ বললেও সেটা আসলে যথেষ্টই দূর। কিন্তু, আমাদের মতোই বহু মানুষ দেখা গেল, সেই দিন ওখানে পৌঁছনো বৃতে বুঝে ওই ‘এলিপোন্তো’-র ঘোলেই দুধের স্বাদ মেটাতে এসেছেন। আমরাও দাঁড়িয়ে পড়ি ছবি তুলতে। চালকের পরামর্শে ওখানে ছবি তোলার নিয়ম মেনে, দু’হাত ছড়িয়ে। তিনিই ছবি তুলে দিলেন আমাদের। মোবাইলে তাঁর ছবি তুলে তাঁকে পাঠানোও হল। ওখানে দাঁড়িয়েই পাশের সুগোরলোফ মাউন্টেন-এর সুন্দর ছবিগুলো তুলতে তুলতে ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে, আমাদের পরের গন্তব্য কোপাকাবানা।

দূর থেকেই বিদায় জানানো হল যিশুকে। পরে কখনও যদি সম্ভব হয়, ফিরে আসব, মনে মনে ভেবে রেখে। কিন্তু না, পরেও আর যাওয়া হয়নি। ফাইনালের পরের সকালেই রিও ছাড়তে হয়েছিল, ফেরার বিমান সাও পাওলো থেকে সেই রাতেই ছিল বলে। মাঝে চেষ্টাও করতে পারিনি আর কোনও দিন। এখন মনে হয়, বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার পর অন্তত দিন তিন-চারেক থাকাটা অবশ্যই উচিত ছিল। এ জীবনে ব্রাজিল আর কখনও যাওয়া হবে না যখন, ৪১ দিনের জায়গায় ৪৫ দিন হলে কী-ই বা এমন ক্ষতি হত?

বাঙালির ছেলের চিরকালই চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। তাই শ্যামল মিত্র শুনেই দিন কাটায় এখন – যাক্ যা গেছে তা যাক্!

1 comment:

  1. Kashi da 7 bochor ager ghotona.. Kintu mone hocche eai sedin ghoteche... Sob chokher samne tumi dekhte parcho... Sotti sob desh barbar Brazil ekbar e... Ki desh.. Footballer charao bhalo manush o oi desh e toiri hoy.. Tomar lekhar opekhay thakbo... Dhynnobad

    ReplyDelete